স্বপ্নবিলাস
এম এ জিন্নাহ

মানুষের দেহের রূপ বদলাতে সময় লাগলেও মনের রূপ বদলাতে সময় লাগে না। মানুষ হলো অনেকগুলো সত্য-মিথ্যার রূপে সজ্জিত একটি বহুমাত্রিক রূপে রূপান্তরিত প্রাণী। পৃথিবীর অনেক কিছু সহজে চিনতে পারা গেলেও, সহজে-যে মানুষ চেনা যায়-না এটা দিপু ভালো করেই জানে । পৃথিবীর প্রায় অনেক মানুষ আছে, যারা ভালো মানুষের ভান ধরে থাকে। মানুষ ঠকিয়ে তারা তৃপ্তি পায়। মানুষ চেনার একটি সাধনা আছে, সাধনা ছাড়া মানুষ চেনা যায় না। দিপু চিনতে পারে, সহজেই চিনতে পারে। এইজন্যই একলা হয়ে থাকে, পথগুলোতে একা একা হেঁটে চলে আপন গন্তব্যের উদ্দেশে । চাকচিক্যতার আড়ালে ভয়ানক যে প্রতিচ্ছবি লুকায়িত রয়েছে, তা সে অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখে। দেখে বলেই নিজেকে নির্লিপ্ত করে রেখেছে। নির্লিপ্ত মানুষের কোনো উদ্দেশ্য থাকে-না, অনিচ্ছাকৃত হেঁটে চলে, ভবঘুরে পরিচয় পার করে দিবসরজনী। দিপুর দীপ্তময় ভবঘুরে দুনিয়াতে সে একাই বাস করে। সেখানে কারো ঠাঁই নেই, ঠাঁই পাওয়ার সুযোগও নেই। কারণ রূপান্তরিত হওয়া মানুষের অবস্থান সেখানে হওয়ার কথা-না, সেখানে যেতে হলে বহুকালের সাধনা প্রয়োজন । সাধনার সুফল পাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অপেক্ষার। মানবজাতির একটা বড় ধরণের দুর্বলতা রয়েছে , কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করতে পারে-না । অপেক্ষা বিরক্তিকর হলেও কিছু মানুষ অপেক্ষা করে প্রিয়জনের জন্য, ভালোবাসার জন্য। ফুল হাতে বহুদিন দাঁড়িয়ে থাকে, ফুল শুকিয়ে যায় , তবুও অপেক্ষা করে পার করে দেয় জীবনের অর্ধ সময় ৷ দিপু কারো জন্য অপেক্ষা করে-না, তবে তার জন্য অপেক্ষা করে। পুবালি বাতাসে কালো চুল উড়িয়ে নীলা পথ চেয়ে থাকে দিপুর আগমনের । দিপু কভু সে পথে ফিরে-না, আর ফিরে চায় না পথের পানে। নীলা তবুও পথ চেয়ে রয়, যদি তাকে পেয়ে যায় সহসা কোনো এক ভোরে কিংবা শীতলকৃত কোনো সন্ধ্যায়! তাহলে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে জানিয়ে দিবে পৃথিবীর সমস্ত প্রণয়াঞ্জলির পরশ । নীলার তা আর হয়ে ওঠে’না৷ দিপুর সাথে সহসা কোনো দিবসে দেখা হয় না তার। আরো কয়েকদিন আগে পার্কে একবার দেখা হয়েছিলো । নীলা দিপুর হাত ধরে একপাশে নিয়ে এসেছে । কোমল কণ্ঠে শীতল করা স্নেহপরায়ণের আবরণে দিপুর কাছাকাছি মিশতে স্বাদ জমালো। তারপর দিপুর ইনিয়েবিনিয়ে কল্প কথার গল্পে নীলাকে ডুবিয়ে দিলো। রাত পার হলো, আবার অদেখার আড়ালে দুইমুখী দুই প্রাণ। মেয়ে মানুষ হুটহাট করে ভালোবাসার কথা বলে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক । দিপু কাউকে ভালোবাসে না, ভালোবাসতেও রাজি নয়। এজন্য সে একা থাকতে ভালোবাসে। পৃথিবীর মানুষ ভালোবাসার মূল্য বোঝে কম। দম নিয়ে নেয়, তবুও ভালোবাসার মূল্য দিতে রাজি নয়।
তা বহু হিসাব, হিসেবনিকেশের মধ্যে জীবন চলছে তার নিয়মানুযায়ী । ভাবনার জমাটবদ্ধ আকাশ দিপুর মাথার উপর। আকাশের মতো বিশাল হবার ইচ্ছা নিয়ে দিপু পূর্ণযাত্রার অর্ধপথে অক্লান্ত শরীরে বসে আছে । চেয়ে আছে ব্যাপ্তিময় মহাকাশ। মহাকাশের মতোই তাকে যে বিশাল হতে হবে, হতে হবে মহা এক মহাপুরুষ । স্বপ্নের বিলাসিতা নিয়ে মহাপুরুষ হয়ে ওঠা নয় , কেবলই পৃথিবীর আত্মমর্যাদা প্রকৃষ্ট করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েই এই যাত্রা। মহাপুরুষ হয়ে ওঠার তেমন কোনো কারখানা নেই , যার মাধ্যমে নিজেকে মহাপুরুষে পরিণত করবে সে। প্রচেষ্টা, আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরশীলতা, দৃঢ় সংকল্প, কর্মনিষ্ঠা, মহানুভবতা, দক্ষতা,সততা ও সৎচরিত্রের প্রয়োগযাত্রার মাধ্যমে একজন মহাপুরুষ হয়ে ওঠা সম্ভব৷ দিপু বুক ভরা আশা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এ পথপ্রান্তরে। নিশীথরজনী গভীরে কিংবা উত্তপ্ত দুপুরের অগ্নিতপ্ত ধূলায় হেঁটে বেড়ায় মনের উৎকৃষ্ট ভাবনার তৃপ্তি মিটাতে। একা একা নিঃসঙ্গী হয়। তার মতে,
পৃথিবীতে মহামানব বারবার জন্ম নেয় না , শতাব্দীতে একবারই জন্ম নেয়। যে জন্মায় সে আপনাতে জগৎশ্রেষ্ঠ।
পৃথিবীর এ রঙ্গশালায় দিপু কেবল একজন মহাপুরুষ হতে চেয়েছে, মানবসম্প্রদায়ের একটি অপূর্ণ আসন পূর্ণ করার আশায় ৷ জীবনকে উৎকৃষ্ট কাব্যের পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কন করতে মহাপুরুষে তৈরি হবে । পৃথিবীর কোলাহল আর মানবসম্প্রদায়ের সমাগমে মহাপুরুষ হয়ে ওঠা যায়-না, নিজেকে মহাপুরুষ হিসেবে গড়তে হলে প্রয়োজন হয় নিজের প্রতি দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ।

চিঠির একটা ইনভিলাফ দিপুর হাতে , ঘামে ভিজে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আছে । নোটবুকের মধ্যে কে যেনো রেখেছে , তা ঠিক তার জানা নেই । জানার কথাও না , কারণ সে কেবল তাকে আলোক শিখায় জ্বালানোর ভাবনায় অনায়াসে পার করে দিয়ে যায় কতদিন , কত মাস । যখন তার বুদ্ধি হয়নি তখন সে মানুষ হতে চেয়েছিলো, আর যখন বুদ্ধি হয়েছে তখন সে মহাপুরুষ হতে চেয়েছে ৷
নিত্য ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দ্রুত ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটাও তার আছে । সে পৃথিবীর ঘন কোলাহল কিংবা মানবসম্প্রদায়ের সমাগম থেকে একেবারেই নিভৃত স্থানে আশ্রয় নেওয়ার ইচ্ছেটা লালন করে আছে , কেবল সেখানেই সে নিজেকে নিজের মতো করে রূপান্তর করতে পারবে ৷ বোকারা পৃথিবীর রূপ বদলাতে চায় , আর বুদ্ধিমান নিজেকে। দিপু কেবল নিজকে শুদ্ধ করতে প্রায় পৃথিবীর সব আনন্দ উল্লাস ভুলে থাকে । প্রেম, ভালোবাসা এগুলো সহজে বুদ্ধিমান ব্যক্তির সঙ্গ ধরতে জানে না। তবে তার সঙ্গ ধরে , সে ভাবে, আমি প্রায় বোকাদেরই দলে ৷ কঠিন মানুষের রূপ থাকে , সহজ মানুষের রূপ থাকে’না৷ যা থাকে তা ব্যক্তিত্বেরই পরিচয়।

চিঠি পড়বে পড়বে ভেবে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলো, পড়া আর হয়নি। পড়ার সময় দেখে চিঠির দুরাবস্থা নেমে এসেছে । নিচের অংশে ডিজাইন করে লেখা – তোমাকে ভালোবাসি । নাম উল্লেখ নেই । কেবল অবাকই হবার কথা। তবে এইসব প্রায় পড়তে হয় , দেখতে হয় । আকর্ষণীয় মায়া মানুষকে আকর্ষণ না করা পর্যন্ত ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না৷ এটা মহাজাগতিক মহা একটা নিয়ম। দিপুর মধ্যে কারো জন্য মায়া জন্মায় না , জন্মানোর কথাও না । যারা নির্লিপ্ত, তাদের কাছে নির্লিপ্ততায় মহান। নিজেকে সংশোধন করতে হলে সর্বপ্রথম নির্লিপ্ত হওয়াটা প্রয়োজন , মানবসম্প্রদায় নির্লিপ্ত হতে পারেনি বলেই তারা অপদার্থতার পরিচয়ে বেড়ে ওঠছে। নিত্যদিনেই তাদের বিরুদ্ধে তাদের সমাবেশ , মিছিল , সংবাদপত্রে খুন হওয়ার শিরোনাম৷ লোভ-লালসা, অর্থের মায়া, প্রিয়জনের মায়া সবকিছুই তাদেরকে ক্রমান্বয়ে পিশাচ করে তোলে। সকল লোভের চেয়েও ভালোবাসার লোভ মানুষকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করে । তাই কেবলই নির্লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। নির্লিপ্ততাকে সম্মান দিতে গিয়ে দিপুর আর হয়ে ওঠেনি ভালোবাসার ছায়া গায়ে মাখা। প্রায় চিঠি আসে, তবে তা একজনের।
হাতে যে চিঠিটা, তাও পূর্বের ঠিকানা হতে আসা ।
লেখার ছন্দ-তাল’ও বেশ পরিচিত ।

প্রিয় মহাপুরুষ ,
পত্রের শুরুতে আপনার জন্য কোমল সৌরভের ভালোবাসা । আপনার চিত্তে ভালোবাসার উৎকৃষ্টতা কবে প্রকাশ পাবে, তাহা আমার অগোচরে । আমি বরাবরের মতোই জানি আপনি নির্লিপ্ত , নির্লিপ্ততাকে ভালোবাসেন। আর এ-ও জানি, মহাপুরুষ-রা প্রণয়ের ছায়াতলে বন্দি হতে চায়-না। যদি কোনোদিন আপনার ভালোবাসার পরশ রেখা উজ্জীবিত হয় , তবে আমার ঠিকানায় একখানা চিঠি পাঠিয়েন। তবে না হয় এ জীবন ধন্য এ নিখিল ধরিত্রীতে।

ইতি
অস্পষ্ট এক দুলালী

রৌদ্র ছায়ায় দিপু চিঠির দিকে চেয়ে বসে আছে রাস্তার এক কিনারে। চিঠির পাতা থেকে চেনা মানুষের গন্ধ । খুবই পরিচিত , এই মুহুর্তে নীলার নামটা তার স্মরণে এসেছে । তাহলে এটা নীলা হবে। বোকা মেয়ে, আবেগ বেশী৷ তাই এইরকম চিঠি লেখে। দিপু আরো ভাবতে থাকে, মাঝেমধ্যে ঠোঁট ভাজ করে হেসে ওঠে।
সহসা কয়েকজন পুলিশ দিপুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশ আসা মাত্রই দিপুর হাতে হাতকড়াও পরিয়ে দিলো। অবাক নয়নে কেবল চেয়ে আছে সে। দু’জন কনস্টেবল দিপুর গা ঘেঁষে পাশে দাঁড়িয়েছে। এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেনো বড় ধরণের কোনো ক্রাইম করে এসেছে । একজনে কড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো – তোমার নাম কি ? সে বললাম , আমার নাম দিপু । হ্যাঁ,তোমাকেই খুঁজছি। হাসিমুখে মোটাতাজা দারোগাটা দিপুর থেকে একটু দূরে সরে ওয়াকিটকি দিয়ে বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে বাংলিশ ভাষায় কোথাও কি যেনো বলছিলো।

পুলিশেরা অন্য যায় করুক না কেন আসামীদেরকে গাড়ি ছাড়া থানায় নেই না। এখন পর্যন্ত কোনোদিন থানার বারান্দায়ও হাঁটেনি দিপু ,আজ মনে হয় থানার মধ্যে থাকা বড় বড় ঐ খাঁচাগুলোর মধ্যে ডুকিয়ে দিবে । কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনে একটি গাড়ি হাজির এলো। পুলিশ দিপুকে ধরেছে একটা প্লাটফর্ম থেকে। অভিযোগ ছাড়া এভাবে কেনো ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার কোনো হিসেব খুঁজে পাচ্ছে না। অতঃপর থানায় নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে আরো অবাক। নীলার বাবা দিপুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষিপ্ত দৃষ্টি দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো, পলক নড়ছে না যেনো। বাংলা সিনেমার শুটিং এর মতো একজন অবিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে বললো – নীলা কোথায় ? প্রতিত্তোরে দিপুও বললো ‘নীলা কোথায় ? – তুমি ভালো করেই জানো নীলা কোথায়, আবার আমাকে জিজ্ঞেস করতেছ কেন ? কোনো লাভ হবে’না, সময় থাকতে বলে দাও না হলে কিন্তু শাশ্বতকালের জন্য জেলখানায় মরবে,এই বলে দিলাম কিন্তু । ঐ দিকে দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দারোগা। যেনো কিছু বললেই ধরবে তাকে । যেসকল পুলিশ ঘুষ খায়,তারা কিছু সময়ের জন্য সরকারের চাকরি ছেড়ে অন্য জনের দখলে আশ্রয় নেয় । এর মূল কারণ হলো টাকা। তবে অধিকাংশ পুলিশ এইসকল কাজে লিপ্ত নয়। দিপু নীলার বাবাকে বললো- ছোট ছোট বাচ্চারা হারিয়ে গেলে খুঁজাখুঁজি হয়, পুলিশের সাহায্য নিতে হয়, বড়দের ক্ষেত্রে হয়’না। হয়’তো গেছে কোথাও, ফিরে আসবে। হয়তো বাসায় চলেও গেছে ৷ নীলার বাবা এস আর মুকুল সাহেব উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বাসায় টেলিফোন করলো। কল রিসিভ হওয়া মাত্রই কেমন জানি শান্তিস্নিগ্ধ হয়ে ওঠেছে। কারণ বাসায় নীলা ছাড়া আর কেউ থাকে’না। দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে মুকুল সাহেব বললো – তুমি কি করে জানলে নীলা বাসায় ফিরেছে ? – মানুষ অনুমানে অনেক কিছু করতে পারে,বলতে পারে। কারো অনুমান লেগে যায়,কারো’টা বৃথা৷ এই ধরুন আপনি অনুমান করেছেন নীলা আমার সাথে পালিয়েছে কিংবা আড্ডা দিচ্ছে। অথচ নীলার সাথে আমার তেমন কথা হয় না। মাঝেমধ্যে নীলা কথা বলতে চায়, কিন্তু আমি বলি না। তারপরেও আপনি অনুমান করেছেন, কিন্তু এই অনুমান’টা আপনার বৃথা গেলো । দারোগাবাবু যে আপনার থেকে টাকা নিয়েছে আমার এই অনুমান কিন্তু বৃথা যায়’নি। কি দারোগা স্যার সত্যি না ? তিনি মুকুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো – কি করতে হবে বলেন, হাত পা ভেঙ্গে পেলি ? অন্যায় ছাড়া কাউকে কিছু করলে আপনার বদলে আমাকে জেল খাটতে হবে। ছেড়ে দিন ওকে। কিছুক্ষণ পর দিপু আর মুকুল সাহেব একসঙ্গে থানা থেকে বের হয়েছি । দু’জনের দু’দিকে যাত্রা ।
দিপু চললো বাসার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সন্ধ্যালগ্ন। হালকা ঝিরঝির বাতাস বইছে । গাঁয়ে নতুন ক্রয় করা নীল রঙের পাঞ্জাবি । আকাশের রঙে রঙ। সবুজের মাঠ ফেরিয়ে খোলা গাঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে দূর থেকে দেখে মনে হবে আকাশের কিছুটা রঙ বাঁকা হয়ে জমিনে ঝুলে আছে । দিপু যখন নীল রঙের পাঞ্জাবি গায়ে দেয়, তখন তার আনন্দের সীমা থাকে না। আকাশের সাথে দিপুর ভারী মিল পাওয়া যায়। দিপু অপর নাম হলো আকাশ। এ নামের মধ্যে অদ্ভুত রকমের আনন্দ খুঁজে পায় দিপু।

আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা কথা বলে যাচ্ছে,
কোনো উত্তর শুনবার ইচ্ছে পোষণ করছে না।
কিরে আকাশ , আমাকে তোর সাথে মিশিয়ে রাখবি ? জড়িয়ে রাখবি নীল রঙের চাদরে ?

এই নামের বিশেষত নিয়ে নীলাকে একদিন বলেছে,
কেনো যে আমার নাম আকাশ রেখেছে তা কেবল বাবা-ই জানে ।
বাবা ছোট কালে আমাকে নিয়ে গঞ্জে যাওয়ার পথে বাবার পরিচিত একলোক পানভর্তি মুখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো –
কি আসাদ মিয়া, কেমন যাচ্ছে দিনকাল ?
– জ্বী ভাইজান ভালো’তো যাচ্ছে দিনকাল। আল্লাহ ভালোই’তো রাখছে, শুকরিয়া ।
– সাথে এটা কে, পোলা নাকি ?
– জ্বী ভাইজান ৷
– দেখতে’তো ভালোই লাগে, নাম রাখলা কি ?
– আতিকুর রহমান আকাশ । তবে ওরে আমার মা দিপু নামে ডাকি । আমি ওরে আকাশ নামেই ডাকি।
– তোমার পোলা’রে দেখতে আকাশের মতোই লাগে , গায়ে নীল জামা’তো। বাহ্ ! ভালো ভালো।
– দেখতে আকাশের মতো হলে’তো চলবে’না ভাইজান, আকাশের মতো বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ হতে হবে । মানুষের মতো মানুষ । তবে মহাপুরুষ হওয়াটা হবে সবথেকে স্বার্থকতার। পৃথিবীর মানুষ মহাপুরুষ হওয়ার লোভ থেকে বেরিয়ে এসেছে , এর ভিতরে মহাপুরুষ হওয়ার লোভ ঢুকিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর বুকে যেনো এক আলোক উজ্জল মানবে পরিণত হয় ।

লোকটা এবার হাসি থামিয়ে দিলো, কেমন জানি গভীর চিত্তে আমার দিকে তাঁকিয়ে থেকে বাবা’কে বললো – মহাপুরুষ! সেটা আবার কেমন মানুষ ?
– দেখতে অবিকল মানুষের মতোই , কোনো পার্থক্য নেই৷। তবে মহাপুরুষদের কোনো কলুষিত নেই, লালসা নেই, পৃথিবীকে গিরে কোনো চাহিদা’ও নেই । মহাপুরুষ’রা থাকে নিষ্পাপ, প্রায় শিশুদের মতোই । প্রায় পৃথিবীর সকল কিছু থেকে তারা থাকে নির্লিপ্ত । মহাপুরুষদের হৃদয় থাকে আকাশের মতো বিশাল ৷ সে বিশালতার কোনো শেষ নেই, শেষ সীমানা বলতে কিছুই নেই । আছে কেবল বিশাল দূরত্বের বিশ্বস্ত আত্মা। যে আত্মায় কোনো কলুষিত ছাই নেই। মানুষের প্রতি মমতা আছে, তবে সে মমতায় নিজেকে জড়িয়ে রাখে’না। সকল স্নেহ মমতা সকলের তরে বিসর্জন দেয় । মহাপুরুষদের জীবন সাধারণ মানুষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ।

বাবা আরো বলতে লাগলো, কিন্তু লোকটা বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো ‘
– আসাদ মিয়া , আমার চোখ ভিজে ওঠলো কেনো ? এই দেখো পানি পড়ছে !
বাবা মুচকি হেসে আকাশের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
– মহাপুরুষদের দেখলে সাধারণ মানুষের ভাবভঙ্গি পাল্টে যায়, মহাপুরুষ সম্পর্কেও বলতে গেলে তাই ঘটে ,শুনতে গেলেও তাই । গা শিহরিত হয়ে ওঠে। আমারও এমনটা হয় ভাইজান ৷
লোকটা আমাকে স্পর্শ করে সরু পথ দিয়ে ছুটে চললো দূর যাত্রায়৷ বাবা আমার হাত ধরে এগোতে এগোতে বললো – অসাধারণ হয়ে ওঠতে পারবে’না বাবা ? এক্কেবারে বড় মানুষ ! তোমাকে বিশ্বলোকে চিনবে, জানবে, এমনটা পারবে না ? আমি না বুঝে বলে দিলাম পারবো । বাবা অফুরন্ত আহ্লাদ শেষ করে আবার বলে ওঠলো ,
– তোমাকে বিশ্ব চিনবে, জানবে এই আশাতে মহাপুরুষ হলে চলবে’না, তুমি নিজের মতো সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার স্পৃহা জাগ্রত করবে । দেখবে বিশ্ব তোমাকে এমনিতেই চিনে যাবে ৷ আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম । বাবা আমার এলো চুলে হাত নাড়িয়ে বললো – তুমি পারবা ।

দিপু সেদিন বলেছিলো, সে মহাপুরুষ হতে পারবে এবং তাকে পারতেই হবে। সে মনে করে যদি এমনটা হা হওয়া যাই তবে সে পুরোপুরিই ব্যর্থ।

একটি মন্তব্য

  1. অনেক সুন্দর হয়েছে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।