জসিম মল্লিক ডাকবিভাগ কী বন্ধ হয়ে যাবে? অনেকদিন থেকেই এই প্রশ্নটি উঠছে। একমাত্র অফিসিয়াল চিঠি আর পারসেল আদান প্রদান ছাড়া ডাকবিভাগের আর কী কোনো ভুমিকা থাকবে? ইন্টারনেটের যুগ এসে এই প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে উঠেছে। ফেসবুক বা টুইটারের মতো বিশাল স্যোশাল নেটওয়ার্কের কারনে হাতে লেখা চিঠির কথা মানুষ ভুলতে বসেছে। আমি নিজেই একসময় হাজার হাজার চিঠি লিখেছি। আমার ছিল অসংখ্য পত্রবন্ধু। কই এখনতো আর আমি ডাকবিভাগের মাধ্যমে চিঠি লিখি না! এখন আমার দিনের অনেকটা সময় চলে যায় ফেসবুকের পিছনে। এমনকি আমার লেখালেখিরও ভয়ানক ক্ষতির কারন হয়ে দাঁিড়য়েছে ফেসবুক। হয়ত একসময় ফেসবুকও তার আবেদন হারিয়ে ফেলবে। আবার কি মানুষ কখনো হাতের লেখা চিঠিতে ফিরে যাবে! নতুন প্রজন্মতো জানেই না একসময় মানুষ হাতে চিঠি লিখত।
প্রশ্ন উঠতে পারে মানুষ চিঠি লেখে কেনো? চিঠি হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের প্রকাশ। মানুষ তার নিঃসঙ্গতা, অনুভূতি তার মনোভাব অন্যের সাথে শেয়ার করতে চায়। চমৎকার বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যকে মুগ্ধ করতে চায়। কথার আবেদন চিরকালই থাকছে। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীতে অনেক কিছু বদলে যায়। এগিয়ে চলে বিশ্ব। হাইটেকের বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজ। ই-মেইল, ইন্টারনেট আর চ্যাটবক্সেরই এখন যুগ। হাইটেকের বিশ্ব অবশ্য গতি আর বেগ দিয়েছে, কিন্তু আবেগের জন্যে আজও মানুষকে বেছে নিতে হচ্ছে ডাক বিভাগকেই। মনস্তাত্তি¡করা গবেষণা করে দেখেছেন এখনও পর্যন্ত হাতে লেখা পত্রটিই মানুষের কাছে লিখন এবং পঠনগত দিক থেকে অধিক আবেগপূর্ণ। মনস্তাত্তি¡কদের ধারনা, অন্য কোন মাধ্যম দ্বারা খবর আদান প্রদান অনেক বেশী কার্যকর কিন্তু আবেগ আর মানসিক সম্পর্কের জন্যে এখনো পত্র নামক বস্তুটিই বিশ্বের জনপ্রিয়তায় এগিয়ে।
চিঠি কখনো কখনো হয়ে উঠেছে পত্র সাহিত্য। সেই সাহিত্যের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন কোন কোন মনীষী লেখক। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র একটি উঁচুদরের সাহিত্য। ১৮৮৭-১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীকে যেসকল চিঠি লিখেছিলেন ছিন্নপত্র প্রধানতঃ তারই সংকলন। বহু চিঠিই রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপ্রত্রে অর্ন্তভুক্ত করেননি। অনেক চিঠির কোন কোন অংশ সাধারনের সমাদরযোগ্য নয় মনে করে বর্জনও করেন। বর্জিত অনেকগুলো পত্র এবং পত্রাংশ মূল খাতা দু’খানি অবলম্বনে ১৯৬০ এর অক্টোবরে ’ছিন্ন পত্রাবলী’ নামে যে গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়, তাতে পাওয়া যায়।
’কথা বলার অভ্যাস যাদের মজ্জাগত, কোথাও কৌতুক-কৌতুহলের একটু ধাক্কা পেলেই তাদের মুখ খুলে যায়.. চারদিকের বিশ্বের সঙ্গে নানা কিছু নিয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় আমাদের মোকাবিলা চলছেই। লাউড স্পিকারে চড়িয়ে তাকে ব্রডকাস্ট করা যায় না। ভিড়ের আড়ালে চেনা লোকের মোকাবিলাতেই তার সহজ রুপ রক্ষা হতে পারে।’ ছিন্নপত্র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এ কথাগুলো লিখে গিয়েছেন। সে সময় ছিন্নপত্রের ৬৭ নং পত্রে যে লেখা হয়েছে, ’ তখন আমি এই পৃথিবীর নতুন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছাসে গাছ হয়ে পল­বিত হয়ে উঠেছিলুম’ এর প্রকাশযোগ্যতা সম্পর্কে কবি নিজের অভিমতটি ব্যক্ত করেছেন।


নজরুলের নিজের হাতের লেখা চিঠি এখনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর চতুর্থ খন্ডে তেষট্টিটি চিঠি রয়েছে, যার প্রতিটিরই রয়েছে সাহিত্য মূল্য। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ত্রৈমাসিক ’ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৬ ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যায় নজরুল ইসলামের ’মুক্তি’ শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হয়। মুক্তি প্রকাশের পর বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকাটির সম্পাদককে একটি পত্র লেখেন নজরুল। পত্রখানি প্রায় ১০ বছর পরে সাপ্তাহিক সওগাতে প্রকাশিত হয়।
বালিকা কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশে রচিত পিতা জওহরলাল নেহেরুর পত্রাবলীর বৃহৎ সংকলন এমনই ইতহাস সমৃদ্ধ যে, আমরা অনেক সময়ই ভুলে থাকি সর্বার্থে বড় এই গ্রন্থটির মূল বৈশিষ্ট। পোশাকি নাম ’গ্লিমসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’। এটি রচিত হয়েছিল কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশ্যে কারান্তরাল থেকে প্রেরিত পিতার…পত্রধারা মাধ্যমে। কিন্তু ব্যক্তি ও সমসময়কে ছাপিয়ে এ গ্রন্থের আবেদন এমনই সার্বজনীন ও সর্বকালীন যে ফিরে ফিরেই পড়তে হয় এই পত্রাবলী। এসব চিঠিতে বিভিন্নকালে বিভিন্ন যুগে ইতিহাস প্রসিদ্ধ নরনারীর প্রতিবেশী হয়ে নেহরু বসবাস করেছেন। কোথাও আবার অতীতের ঘটনা ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কালকে রক্ত-মাংস দিয়ে জীবন্ত রুপে সাজিয়ে তুলেছেন।
বুদ্ধদেব গুহর পত্রোপন্যাস ’সবিনয় নিবেদন’ একটি অসাধারন গ্রন্থ। শুধুমাত্র পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে রচনা করা একটি পূর্নাঙ্গ ও কৌতুহলকর উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে অভিনব সংযোজন। শুধু আঙ্গিকগত নতুনত্বের জন্যেই এ উপন্যাস বিশিষ্টরুপে নন্দিত হবে না, হবে এ সামগ্রিক আবেদনের জন্যও। বুদ্দদেব গুহ এর উপন্যাসে দীর্ঘকাল ধরেই চিঠিপত্রের একটা আলাদা স্থান। ’একটু উষ্ণতার জন্য’র ছুটি ও সুকুমারের অথবা ’মাধুকরী’র পৃথু ও কুর্চির চিঠির কথা উলে­খ করা যায়। ব্যক্তিজীবনেও চমৎকার চিঠি লেখেন বুদ্ধদেব গুহ। কিন্তু এই উপন্যাসে পত্রবিলাসী কথাকার যেন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে উঠেছেন।
পুরীর পোস্ট মাস্টার একদিন তার অফিসে ’ভগবান/জগন্নাথের মন্দির/ পোস্টাপিস পুরী’ এই ঠিকানায় লেখা কয়েকটি চিঠির সন্ধান পান। ভগবান নামে কোন লোককে পিয়ন খুঁজে পাননি। কৌতুহলী হয়ে তিনি একটু কুন্ঠার সঙ্গে খাম ছিঁড়ে চিঠিগুলো পড়ে দেখেন যে সেগুলো খোদ ভগবানকেই লিখেছে কলকাতা থেকে ওরফে পোনু নামের একটি ছোট ছেলে। ভগবানের কাছে পোনুর কাতর মিনতি, তিনি যেন তার সমস্যগুলো মিটিয়ে দেন। পোনু তখন বাংলা বানান শুদ্ধভাবে লিখতে পারে না। সেই ভুল বানানেই চিঠিগুলো একের পর এক সাজিয়ে দিয়েছেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তার ’পোনুর চিঠি’ বইয়ে। সব বয়সের পাঠক এই চিঠিগুলোর কৌতুক রস সমানভাবে উপভোগ করে থাকেন।

৩.
যামিনী রায়ের চিঠির মূল্য অসীম, কারো চিঠি ছাড়া অন্য কোন লিখিত ভাষ্যে নিজের মনের কথা নথিবদ্ধ করেন নি তিনি। যামিনী রায়ের শিল্পী সত্বাকে বুঝতে হলে মানুষটিকেও সম্যকরুপে জানতে হবে। সে উদ্দেশ্য সাধনে চিঠিই একমাত্র সহায়। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা যামিনী রায়ের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ-বিজয়চন্দ্র সম্পর্কেও ইতিহাস রচনার অসম্পূর্ণতা দূর করা সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ বিজয়চন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের সমস্ত চিঠি-পত্রাদির অভাব। কালিদাস নাগ প্রবাসী পত্রিকায় চারখানি চিঠি সংকলন করেন তখন (১৩৫০ বঙ্গাব্দ)। তিনি আট ন’খানির বেশী চিঠি লেখেন নি। সূচনাতে তিনি লেখেন ’…তার কন্যা সুলেখিকা সুনীতি দেবী যে চিঠিগুলো রক্ষা করেছেন সেগুলো নকল করে আমাদের পাঠান…।
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৫-১৯৬১) বাংলা সাহিত্য জগতে বিভিন্ন দিক থেকে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। প্রমথ চৌধুরীরর সঙ্গে ধূর্জটি প্রসাদের গল্পগ্রন্থ ’রিয়ালিস্ট’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে দীর্ঘ চিঠি দেন, তা প্রকাশিত হয়েছে ’পরিচয়’. বৈশাখ ১৩৪১ সংখ্যায়।
সাহিত্যের সঙ্গে চিঠিপত্রের একটি নিবিড় সংযোগ রয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে চিঠিপত্রের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অনেক সাহিত্যিকই বিভিন্ন সময়ে চিঠি লিখেছেন আপনজনদের। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই বেশী পত্র যোগাযোগ করেছেন। এখনো তাঁর লেখা চিঠি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেটি চিঠির আবেদন চিরন্তন বলেই।
বাংলাদেশে তরুন-তরুনীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পত্র বিনিময় বা একে অন্যের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী করতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে শাহাদত চৌধুরীর অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রা। বিচিত্রার জন্মের শুরু থেকেই ’পাঠকের পাতা’ জনপ্রিয় হতে থাকে। এই বিভাগের মাধ্যমে পাঠকদের মধ্যে একধরনের যোগাযোগ সূত্র তৈরী হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে যখন ’ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ বিভাগটি শুরু হয় তখন একটি প্রচন্ড আলাড়ন তৈরী হয়। এটাকে বলা যায়, সে সময়ের চ্যাট বক্স। বিভাগটি তখন আর একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে উঠে সব বয়সীদের পত্রালাপের বা বিজ্ঞাপনালাপের বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *