একটি বর্ণাট্য দিনলিপি • মুহাম্মদ রাসেল হাসান
এক.
নব্য লেখিকা অর্পিতা সামান্ত তিন্নি। আমার জ্যোৎস্নাধোয়া রাত কাব্যগ্রন্থটি রূপক লাইব্রেরি থেকে কিনে পাঠশেষে ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানানোর পর থেকে অর্পিতা’পুর সাথে গাঢ় সখ্যতা গড়ে উঠে। আজ তাঁর সাথে প্রথম দেখা হবে। টেলিফোনে কথামতো নেত্রকোণা সরকারি কলেজের ব্যবসায় প্রশাসন ভবনের অদূরে শতবর্ষী একটি রেন্ট্রি গাছের নিচে পরস্পরের দেখা হলো। বাঙালি মেয়েদের চির অভ্যাসগত কিংবা স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে তিনি প্রথম দেখার অভ্যর্থনা জানালেন। পূর্বেই উচ্চস্তরের পাঠিকা জেনে তার জন্য নেওয়া দুটো বই প্রদান করে শুভেচ্ছা ও ভাব বিনিময় হলো। এরপর পায়চারি করতে করতে কলেজের অনতিদূরে মেইনরোডে উঠে অটোতে উঠে, বিচিত্র প্রলাপ করতে করতে ‘মিঠাই কফি হাউজ’র সামনে নামি। অভ্যান্তরে প্রবেশ করে অজানা কারণে কফি হাউজ বন্ধ পেয়ে পুনরায় পায়চারি করতে করতে বড় বাজারের ‘হ্যালো ফুসকা’য় প্রবেশ করি। অর্পিতা’পু আমার চয়েজমতো দুটো ফুসকা অর্ডার করেন। খেতে খেতে সেকি রকমারি আলাপ, তবে হ্যাঁ সাহিত্য থেকে খুব দূরে যাওয়া হয়নি। খাওয়া শেষেও বাহারি কথোপকথন হলো। এক পর্যায়ে বয়োকনিষ্ঠ হিসেবে ক’টা উপদেশ বাণীও আমার উপর হুমরি খেয়ে এসে পড়ল। ঘড়ির কাটায় দেখা গেল, ছয়টা বাজতে অবশিষ্ট আর কিছুক্ষণ। ছয়টায় তাঁর মেসে থাকতে হবে। অতঃপর আজকে মতো উঠলাম। পূর্বের ধারণাকে বৃথা যেতে না দিয়ে কল্পনার মতোই ধ্রুপদী মেয়েটি বাস্তবে চিন্তভাবনায়ও অনবদ্য বলে উপনীত হলো।
বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছে তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে। জেনে অবাক হলাম মেসে তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ। টের পাওয়া গেলনা, আবার হেটেই আমরা তেরী বাজারের মোড়ে চলে আসছি, অর্পিতা’পু বিদায় নিয়ে একটি অটোতে উঠলেন। শিক্ষক ও শিক্ষিকা দম্পত্তির মেয়ে অর্পিতা সামান্ত তিন্নি মেসে একাই রান্নাবান্না করে খান, বান্ধবীহীন একাই থাকেন। একাকীত্বকে নিশ্চয়ই তিনি যাপন করছেন প্রবলভাবে- এমনটা ভেবে সামনে তাকাতেই রাজপথে অনেকগুলো চলন্ত অটো দেখা গেল, কিন্তু বিদুষী সুন্দরী মেয়েটি কোন অটোতে, তা আর বুঝা গেলনা।
দুই.
সাতটা থেকে আমাদের আড্ডা। সময়টা যাপন করতে হবে, কোথায় করা যাবে ভেবে মনে হলো সরকারি গ্রন্থাগারে কাটানো যেতে পারে। লাইব্রেরিটির সামনে নামতেই দেখা গেল সে আর আমার জন্য খোলা সেই। তখন চোখ পড়ল এর সংলগ্নেই কালেক্টরিক মাঠের বৃক্ষমেলায়। কবি তানভীয়া’পুকে ফোন দিয়ে কথা বলতে বলতে মেলায় প্রবেশ করে বাহারি রঙের অনেক কিশোর গাছগাছালি দেখা গেল। জনশূন্য এই মেলায় আরো দেখা গেল দুটি ছেলে আর একটি ঝাকড়া চুলের স্টাইলিশ সেক্সি মেয়ে বিচিত্র আলাপে অট্টহাসিতে মেলাটি আকাশে তোলার উপক্রম করে তুলেছে। নিঃসঙ্গ হওয়ায় নিজেকে অসহায় লাগলে মেলায় আর থাকা আমার বেমানান মনে হলে প্বার্শবর্তী পাবলিক লাইব্রেরির সহ-সভাপতি আলোর মানুষ বীরমুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আব্দুল হান্নান রঞ্জন মহোদয়কে ফোন দিলাম, বিদগ্ধ মানুষটার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলে সময়টার যথার্থ ব্যবহার হবে মনে করে । তিনি বললেন, রাসেল আমি লাইব্রেরিতে না, মোক্তারপাড়া ব্রিজের ওপারে আছি, এখানে এসে পড়ো, চা খেতে খেতে কথা বলি। বলে রাখি যে, পরনে ইউনিফর্ম আর সাথে আইডি কার্ড না থাকায় স্টুডেন্ট হয়েও প্রাপ্তবয়স্কদের মতো দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হচ্ছিল সর্বত্র।
রঞ্জন দাদার সাথে তাঁর সৌজন্যে চা খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। বেশ কিছু বিষয়ে পরামর্শও নিলাম এই পরম আন্তরিক মানুষটির কাছ থেকে। কর্ণে মাগরিবের আজান ধ্বনিত হলো, দাদা নামাজে যাবেন, আমি যাবো আড্ডাস্থলে। সান্ধ্য আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে আসলাম বোধ কার্যালয়ের দিকে।
তিন.
শহরের মোক্তারপাড়া-স্থ কবিতা প্রাঙ্গণে মগড়া নদীর উপকূলে আমাদের বোধের অফিসে দুটো অনুষ্ঠান। একটি জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এঁর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা ও স্মরণ, অন্যটি ২৩১তম বোধ সাহিত্য আড্ডা এবং কবি দেবব্রত দাদা ও কবি পহেলী দিদির কন্যা দ্রাঘিমা প্রচ্ছদ এর জন্মানুষ্ঠান। একটু পরেই আড্ডায় শুরু হলো মহান কবিকে নিয়ে আলোচনা। স্বীকার করতেই হবে বোধ সম্পাদক ভালোবাসার কবি তানভীর জাহান চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই আড্ডাটি মহিমান্বিত হয়েছে- একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরীর পুত্র- লেখক, বীরমুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক প্রফেসর ননী গোপাল সরকার, কবি অধ্যাপক খন্দকার অলিউল্লাহ্ ও কবি অধ্যাপক রেজাউল করিম স্যারের প্রানবন্ত আলোচনার মাধ্যমে। হায়দার কাকা কবিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন অনেকবার, সেই স্মৃতিগুলো চারণ করলেন, তাঁর পিতা মরহুম খালেকদাদ চৌধুরী নজরুলের স্নেহধন্য ও তাঁর ধুমকেতু পত্রিকার সাব এডিটর ছিলেন। পিতার কাছ থেকে শুনা কবি সম্পর্কে অনেক নতুন কাহিনি শুনালেন। সারোয়ার মামাও নজরুলকে কাছ থেকে দেখেছেন, তিনিও সেই স্মৃতিচারণ করলেন।
চার.
ননী স্যারের প্রথম অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হলো দ্রাঘিমা প্রচ্ছদ এর জন্মানুষ্ঠান। এতেও বক্তারা তাঁর জন্য আশীর্বাদ কামনা করে কথা বললেন।
আমি বলি, কবি কুসুমকুমারী দাসের ছেলে জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি হয়েছেন। দ্রাঘিমার শুধু মা কবি না, বাবাও কবি। দ্রাঘিমা কি হবে, আল্লাহই জানেন। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা উপহার দিলে আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব।” শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবীর প্রথম কাতারেই প্রথমেই তো কবিগণ। সেক্ষেত্রে কবি Debabrata Das দাদা ও কবি পহেলী দে দিদির কন্যা জাতিকে কি উপহার দিবে তা ভাবা কঠিন।
কেক কাটার পর আমরা বেরিয়ে পড়ি। মেইনরোডে এসে রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।
পাঁচ
পহেলীদি রাস্তা থেকে রিতিমতো জোর করে সকল কবিদের নিয়ে এলেন ষড়ঋতু হোটেলে। ওখানে জমে উঠলো আরেক উল্লেখযোগ্য আড্ডা। বেশ প্রশস্ত ও দীর্ঘ টেবিল ঘিরে বসেছি সবাই৷ আমার ডানে অধ্যাপক রেজাউল স্যার, বামে আঙ্কেল (দ্রাঘিমার নানা), এই আড্ডাটি ঠিক সম্মিলিতভাবে না, দুই তিনজন করে করে আলাপে মগ্ন। আমি, রেজাউল স্যার, আঙ্কেল ও পহেলী দিদি কথা ও কবিতায় কাটিয়ে দিলাম আধা ঘন্টা। মাঝে মাঝে সবার সাথেই আবার টুকরো টুকরো কথা হচ্ছিল। কবি দম্পত্তির সৌজন্যে নান রুটি, চিকেন ফ্রাই ও কুল ড্রিংক পুরোটা না খেতে পেরে অনেকের মতো আমিও প্যাক করে নিলাম।
এদিকে আব্বা বাড়ি থেকে রেলক্রসিং পর্যন্ত মানে ৬ কিলোমিটার যেতে ৩বার ফোন দেন, কোনো সমস্যা হয় কিনা বা কোনো বিপদে পড়েছি কিনা- এ ব্যাপারে খু্ব উদ্বিগ্ন থাকেন। সেখানে বিকাল থেকে রাত এগারোটার মতো বেজে গেছে, বুঝতেই তো পারেন। একেকবার ফোন দিচ্ছে একেক জায়গার কথা বলছি। তাঁর অবস্থান থেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, সত্যিই কি এখানে নাকি কোনো বিপদে পড়ে বসে আছি। সবগুলো কল গুণলাম, বেশি না, মাত্র ২৭টা কল এসেছিল আব্বার। অমায়িক আন্তরিক ও অত্যন্ত উন্নত চিন্তাধারার উত্তরাধিকারী কবি দেবু’দা ও পহেলী’দি তাঁদের বাসায় নিতে জোর করছিলেন। ওখানে গেছি বললে আব্বা কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন, মাবুদই জানে। হয়তো জেলখানায় খবরও নিতেন। অতঃপর বিদায় নিয়ে বের হই।
ছয়.
মেইনরোডে এসে অটোতে উঠি। আগে বুঝতে পারিনি অটোচালক নেশা করে এসেছে। রাস্তায় কি ভয়ঙ্কর কথারে বাবা! অটোর ব্রেক ধরে রেখে মাঝে মাঝে আমার উপর ঢলে পড়ে যেতে চায়। কোনো মতে আল্লাহ আল্লাহ করে তেরী বাজারের মোড়ে নেমে পড়ে আরেকটি অটোতে উঠে রেলক্রসিং নেমে সিএনজিযোগে হাটখলা বাজারে নামি। পকেটও রিক্ত হয়ে এল, কাজেই এমবি ভরা আর হলোনা। বাজারের আলো কমে এসেছে। দোকানের শার্টারগুলো তীব্র শব্দে নিচে নেমে যাচ্ছে। পথ হাটছি। পথে আমি একা। দুপাশের ছোট ছোট গ্রামগুলোতে নির্জন গাম্ভীর্যতা। সারাদিন পরিশ্রম করে সকল মানুষ নিদ্রা দেবীর কোলে শায়িত হয়েছেন। ঝিঝিপোকা ডাকছে। ঝোনাকিরা এমন সময় গ্রামের পথে মানুষ দেখে অভ্যস্ত না থাকায় আমাকে এসে ঘিরে ধরেছে। দুটি জঙ্গল পেরিয়ে অন্ধকার, নির্জন, ঝিল্লিরবের ভিতর দিয়ে আমি নিড়ের উদ্দেশ্য হেটে চলেছি।
লেখা সমাপ্ত হলো- রাত ১টা ৫৪
প্রথম প্রহর ২৮শে আগস্ট ২২
নগুয়া কুশলগাঁও, নেত্রকোনা।