বাজি
রফিকুল নাজিম

বিটুলের সাহসের ব্যাপারে বন্ধুমহলে বরাবরই সুখ্যাতি রয়েছে। বিটুলকে সবাই ডানপিটে ছেলে হিসেবে জানে।তাই বলে এতো রাতে শ্মশানে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটা সে তুড়ি মেরে লুফে নিবে- এটা বোধ হয় জহির, শাহিন, শরীফ ও রোমেলদের কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তাও আবার মাত্র সতেরোটা পরোটা, দু’টো ডিমের অমলেট ও তিন বাটি ডালভাজির জন্য! বিটুল চ্যালেঞ্জটা নিয়েই নিলো। সে মধুরঘাটের শ্মশানে যাবে। এই দুঃসাহসিক অভিযানে সে তার সাথে করে একটা দিয়াশলাই বক্স ও লোহার নাটবল্টু নিলো। বিটুল কার কাছে যেনো শুনেছে- আগুন আর লোহা নাকি ভূতদের জন্য সাক্ষাৎ যম। সাথে লোহা আর আগুন থাকলে নাকি ভূতেরা ভয়ে দৌঁড়ে পালায়!

মধুরঘাটের শতবর্ষী শ্মশানকে ভয় পায় না- এমন লোক এই তল্লাটে পাওয়া যাবে না। গতকাল রাতেও নাকি আতর মুন্সিকে জুতসই করে ধরেছিলো। রাতে গঞ্জ থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো তার। আতর মুন্সিকে নাকি টেনে হিঁচড়ে ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিলো। একটা ভূত নয়। ভূতের পুরো দল। সেই দলে ছিল মেছো ভূত, গেছো ভূত, মুরুব্বি ভূত, পিচ্ছি ভূত। তারপর ঘন্টা ব্যাপী সেইরকম ধস্তাধস্তি! যমে-জীবনের যুদ্ধ। আতর মুন্সি এ তল্লাটের সেরা কুস্তিগীর। তার উপর ভালো সূরা কেরাত জানা লোক। তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। জায়গাটা খুবই দূষিত। বকুলপুরের কম বেশি সবাই ওখানে ভূত দেখেছে। একটা ভূত না, শত শত ভূত নাকি শ্মশানে খেলা করে। ভূতগুলো কখনো বিড়াল, কখনো কুকুরের রূপ ধরে। সেই শ্মশানেই এতো রাতে বিটুল একা যাবে! এই পৌষের রাতেও শরীফ ঘামছে। শাহিন শীতে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘বিটুইল্লা, চল্ বাড়িত যাইগা। শ্মশানো যাওন লাগতো না। এত্তো সাহোস ভালা না। চল্ বাড়িত।’ ‘কালকা ইশকুলে যাওন লাগবো। মনে আছে- কালকা আমগোর বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিবো। আর এই শ্মশানডা খুব খারাপ জায়গা।’-বিটুলের কাঁধে হাত রেখে বললো জহির। সবার কথা চুপ করে শুনছে বিটুল। কোনো কথা বলছে না সে। চার বন্ধু বিটুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে কিছু একটা গভীরভাবে চিন্তা করছে।রোমেল বিটুলের শরীর ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি এতো ভাবতাছোত?’ এবার বিটুল মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক সিদ্ধান্ত জানালো। তার মানে সে শ্মশানে যাবেই। এটা মানসম্মানের ব্যাপার। বাজি তাকে জিততেই হবে। ‘তোরা এখানেই অপেক্ষা কর। আমি তোদের শর্ত মতো শ্মশানের পোড়া কাঠ লইয়া আইতাছি।’- বলেই বিটুল শ্মশানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

পৌষের রাত। অন্যদিনের মতো আজ কুয়াশা নেই। হালকা চাঁদের আলোও আছে। হালকা আলো আর হালকা কুয়াশার চাদরে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।যাদুপুরীর মতোই। বিটুল শ্মশানের দক্ষিণ পাশের বটগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ ছোঁ করে কিছু একটা বিটুলের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। ভয়ে একটু সরে পেছনে এসে চারপাশ ভালো করে দেখছে বিটুল। এই শ্মশানের মতো ভয়ংকর জায়গায়ও বিটুলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে! হয়তো ভয় কমানোর একটা কৌশল বিটুলের এই হাসি! শ্মশানের চিতা থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এখন কিছুটা ভয় হচ্ছে বিটুলের। কয়েক কদম সামনে যাওয়ার পর বিটুলের পায়ের নিচে মটমট করছে ভাঙছে একটা কিছু। বিটুলের শরীরটা হীম হয়ে আসলো। ভয় পেলে চলবে না- বলে নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছে বিটুল। দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বালিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো পায়ের নিচের জিনিসটা কী? দেখে তার পায়ের নিচে ভাঙা মাটির কলসের ঢেলা। এবার চিতার কাছেই অর্ধেক পোড়া কাঠের টুকরো খুঁজে পেলো।হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ বিটুলের কানে ভেসে এলো।বিটুল থমকে দাঁড়ালো। নিজের বুকেই থু থু ছিটালো।তারপর গলায় পরা আল্লাহ লেখা তাবিজটা এবার সে শক্ত করে কামড় দিয়ে ধরেছে। কান্নার উৎস খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলো কালো একটা কুকুর কাঁদছে। বিটুল কুকুরটাকে চিনতে পেরেছে। এটা অনিল কাকুর পোষা কুকুর। দক্ষিণ পাড়ার অনিল কাকু গত হয়েছেন তিনদিন হয়। কুকুরটার কান্না দেখে বিটুলের খুব মায়া হয়। কুকুরটাকে আদর করতে যাবে- এমন সময় কুকুরটা ভয়ে দিলো ভোঁ দৌঁড়। কুকুরের ভয়ে পশ্চিম পাশের ঝোপের আড়াল থেকে চারজন হুড়মুড় করে ছুটে আসছে বিটুলের দিকে। বিটুল এবার সত্যিই সত্যি ভয় পেয়ে গেলো। চার বন্ধু বিটুলকে জড়িয়ে ধরে সূরা কেরাত পড়ছে। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বিটুল তাদেরকে বললো, ‘চল এবার যাই। পরোটা ডিম ভাজি খামু। তাড়াতাড়ি চল। নইলে লালু কাকা চুলা বন্ধ কইরালাইবো।’

লালু কাকার দোকানের বেঞ্চিতে পা তুলে বসছে বিটুল।মনে হচ্ছে সে চাঁদ জয় করে সবে মাত্র মাটিতে পা রেখেছে। বিটুল একটা একটা করে তেরোটা পরোটা খেয়ে বললো,’আর পারতাছি না রে। নে, এবার এই চারটা পরোটা তোরা চারজন ভাগ করে খা। আর তোরা না থাকলে আমার এই ‘শ্মশান অভিযান’ সফল নাও হতে পারতো।’ সবাই অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, কী বলতাছোত! কিছুই বুঝতাছি না।’ বিটুল মুচকি হেসে বললো,’বটগাছের আড়াল থেকে এই চারটা ভূত আমাকে বেশ সাহস জোগাচ্ছিলো।’ বিষয়টা এখন সবার কাছে ফকফকা-পরিষ্কার। চার বন্ধু বিটুলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *