অগোচরে লুকানো
শাহারিয়ার ইমন
যে দিন ইমন নিজ গ্রাম ছেড়ে দিবার সিদ্ধান্ত নেয়,তখন তার হাজারো কষ্টের কথা মনে হতে থাকে।জীবনের কোন গতিতে মানুষ কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তার নিদিষ্ট কোন সীমারেখা নেই। আজ যে পথে ইমন পাড়ি জমাচ্ছে তারও কোনো গতি রেখা বা সীমানা বলতে তার কিছুই জানা নেই।
মানুষ চলমান সে কোনো জায়গায় স্থির না।প্রাকৃতিক নিয়মে চলতে থাকে।আজ ইমন এমন অজানা এবং প্রাকৃতিক নিয়মে নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে।ইমন তার গ্রামের সাথে তার সম্পর্কটা ছিল জন্মসূত্র থেকে। এই গ্রামে জন্ম,বেড়ে উঠা,প্রতিটা পথ-ঘাট চিরচেনা।মানুষ জনদেরকে তার আরো বেশি চেনা।গ্রামের মাটির তার গায়ে গন্ধ এখনো আছে বলে ইমন দাবি করে।
এই গ্রামে তার কতো স্মৃতি মনে পড়ে।
রোজ ভোর সকালে আম জাম বড়ই সুপারি নানান সময়ে নানান ফল কুড়ানো।বাজারে বিক্রি কার সহ আরো কত কি।সুযোগ বুঝে পাশের গ্রামের গিয়ে রাতে
নারিকেল আতা লিচু জাম্বুরা চুরি করা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার।
স্কুলে গিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শানুদের দোকানে সিডিতে বাংলা ছায়াছবি দেখা।
বিকেলে গোল্লাছুট, কানামাছি,ফুটবল খেলে
তার দিন কাটত।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ঘুমানোর আগে ভূতের কেচ্ছা শুনে ভয় পাওয়া।প্রস্রাব ধরলে রাতে বাহিরে না গিয়ে জানালা দিয়ে প্রস্রাব করা।
এই ভেবে ইমনের দুই চোখ কান্নায় ছলছল করে। মনে হয় সে যেন কোথায় অজানা রাজ্য হারিয়ে যাচ্ছে এই আপন গ্রাম ছেড়ে।
কোন দিন ভাবে নাই যে গ্রাম ছেড়ে তার চলে যাবে।আর গ্রামের জন্য এমন মায়া কোন দিন হয় নাই ইমনের।
ইমনদের এক সময় সব কিছু ছিল।
চৌ-চালা ঘর,রান্না ঘর,গোয়াল ঘর,বাড়ির সামনে পুকুর,হাঁস,মুরগি,কবুতর।
সময়ের ব্যবধানে সব কিছু হারিয়ে গেল।
মানুষের ধন-সম্পদ,অর্থ-কড়ি,সম্যান তৈরী করতে কত সময় লাগে কিন্তু তা ধ্বংস হতে কোন সময় লাগেনা।ইমনদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে।
আব্দুল ছিল ইমনের বাবা, তার বাবার গ্রামের বাজারে মুদির দোকান ছিল।
তাদের ব্যবসা অনেক ভাল চলছিল,
সংসারে কোন অভাব ছিল না। আব্দুল শহরে গেলে ইমননের জন্য কত কিছু আনতো।
হঠাৎ বাজারে এক চুরি হয়।আব্দুলকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চুরদের সাথে সম্পর্ক ছিল বলে পুলিশ তাকপ ধরে নিয়ে যায়।দিন এক পরে তাদের বাজারের দোকানটা মতি বেপারী কেড়ে নেই।
তখনি ইমনদের পরিবারে নেমে আসে অমবস্যার মতো অন্ধকার।সুখের ছায়া পর্যন্ত দেখা না পাওয়া।কেননা ইমনের বাবাই এক মাত্র রোজকার করত।সংসারে যদি যে উপার্জন করে হঠাৎ কোন কারণে রোজকার বা সংসার চালাতে ব্যর্থ হয় তখন বুঝায় যায় অভাব কিভাবে গ্রাস করে।
তার মা জহুরা তার স্বামী কে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য গরু,ছাগল বিক্রি
করে দেই।
এমন কি এক সময় তাদের ভিটা বাড়ি বন্ধক দেয় মতি ব্যাপারীর কাছে।তবুও ইমন তার বাপকে ছারিয়ে আনতে পারে নাই।
ইমনের মার ছিল হাঁপানি।মাঝে মধ্য তার শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়।শ্বাস নিতে পারে না।
আরো নানা রোগ তাকে কাবু করেছে।
এক সন্ধ্যায় ইমন ঘরে ঢুকে দেখে ঘরে বাতি দেওয়া হয়নি। সে তার মাকে ডাকে কিন্তু কোনো সারা নেই।সারা না দেওয়াতে
ইমনের মনে এক ধরনের ভয়ের শঙ্কা গ্রাস করে,এমনটা কখনো হয়নি। বাড়ির ভেতর ঢুকলে তার মা কিভাবে টের পেত আজো তার কাছে রহস্যময়।তবুও আবার তার মাকে বারবার ডাকে তবুও সে কোনো শব্দ শুনতে পাইনি।
কুপি দিয়ে আলো জ্বালানো হয়,ঘরের সকল রুমে তার মাকে খুঁজে পাইনি।
ইমন এবার শান্ত হয়ে পাটি পেতে মেজেতে শুয়ে থাকে। এবং ইমন ভাবে তার মা মনে হয় পাশের বাড়িতে বুঝি গেছে।
ইতিমধ্যে তার ঘুম চলে আসে।
রাত চলে গিয়ে সকাল হয়,
ইমনের ঘুম ভাঙ্গে দেখে তার মা এখনো ঘরে আসে নাই।
ইমন তখন তাদের পাশের বাড়িতে গিয়ে খবর নেই তারা বলে তার মা আসে নাই।
ইমন বাড়িতে চলে আসে,
তখন ইমনের মনে হয় আজ সে যেন অনেক ক্লান্ত।তার পা যেন অবস হয়ে আসছে মনে হচ্ছে তার দুই চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।
শূণ্যের উপর ভেসে উড়ছে।
একটু পরে তার তৃষ্ণা পাই পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে যাই গিয়ে দেখে তার মা জুহুরা চিৎ হয়ে পড়ে আছে।
ইমন চিৎকার করে তার মাকে ডাকে কোন সারা শব্দ নেই। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে মা বুঝি মরে গেছে।
জুহুরার নাকে এবং মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়েছে নাকি?
সারা শরীলে মাটি লেপ্টে আছে। কয়েকটা পিঁপড়া নাক থেকে বের হচ্ছে তখন ইমন নিশ্চিত হয়ে গেছে যে তার মা মারা গেছে।
তার চিৎকার শুনে পাশের বাড়ি থেকে আবুলের মা,মমিন ভাই,আতা কাকা আসে।
বলে কি হইছে রে ইমন ?
ইমনের মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারে না।
তারা ইমনের মায়ের কাছে আসে দেখ জুহুরা মারা গেছে।
আতা কাকা ইমন নিয়ে বাহিরে আম গাছের নিচে বসাই।
আবুলের মা মরা দেহকে চাদর দিয়ে মুরিয়ে দিচ্ছে।
মমিন ভাই পাশে বসে শান্তনা মূলক কথা বলে।
আতা কাকা বলে তর মার হাপানি ছিল বলে শ্বাস কষ্টে রান্না ঘরে মরা যায়।
শোন,
এখন লাশ কাফন দাফন করতে হবে।
তর কাছে কি নগদ টাকা আছে?
ইমন মাথা নাড়াই বলে আমার কাছে কিছু নাই।
তবে তর মার লাশ দাফন করবি কি ভাবে?
ইমন বলে…….
আমার ভিটা বিক্রি করে আমার মার দাফন করব।
ইমন ছুটে যায় মতি বেপারীর বাড়িতে
বলে বেপারী সাব আমার মা মারা গেছে দাফনের জন্য টাকা লাগবে কিছু টাকা দেন।
বেপারী বলে…….
তর মা তর বাপ কে জেল থেকে খালাস করার জন্য বাড়ি বন্ধক দেয়।
সেই বাড়ি বন্ধকের টাকা এখনো দেয় নাই
আবার ভিটা বাড়ি বেঁচে দিবি।
ঠিক আছে।
ইমন কিছু নগদ টাকা নিয়ে কাগজে সই করে বাড়ি বিক্রি করে দিল।
দুপুরের পরে তার মাকে গ্রামের গন কবরে দাফন করে করে আসে।
ইমন বাড়িতে আসে কান্নায় অচেতন হয়ে যায়।
যখন তার চোখ খুলে দেখে আকাশে আজ চাঁদ উঠছে।চাঁদের চারপাশে হাজারো তারা।
তারার পতন হয় তার শূণ্যতা পূর্ণ হয়।কিন্তু কাছের মানুষ চলে গেলে তার ভালবাসা অপূর্ণ থেকে যাই।মানুষের দূর্ভলতা হলো কারো মায়ায় ভেতর ঢুকে না আসতে পারা।
ইমন ভাবনায় ঢুকে যায়, আমার সব ছিল আজ কেউ নেই। মা,বাবা এমনকি ভিটা বাড়িও আজ আমার নেই।এভাবে বুঝি জীবন পাল্টায়।
কিছুদিন গ্রামে থাকার পর ইমন গ্রাম ছেড়ে
শহরে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেই।
যাওয়ার আগে আতা চাচার বাড়ি যাই
গিয়ে বলে চাচা আমি গ্রামে আর থাকব না।
শহরে চলে যাব।
আতা চাচা বলে কেন রে বাপ?
বাবা মিথ্যা মামলায় জেলে,মা মারা গেছে
ভিটা বাড়ি বিক্রি করছি।
এখন ত আমার কেউ নেই,
এই বলে গ্রাম ছেড়ে বাপ দাদার ভিটা বাড়ি ছেড়ে।
আতা চাচার ঘরের দরজার দাঁড়ানো তার মেয়ে সুহেনা।
সুহেনা আমার আর আতা চাচার সব কথা শুনছে।তার মুখটি মলিন।বোধ হয় আমি চলে যাওয়াতে কষ্ট পাবে।
সুহেনা আমার ছোট,এক সাথে ছোটবেলা কত খেলছি।
এখনো মনে আছে তার একটা পুতুলের সাথে আমার পুতুলের বিয়ে দেয়।
সুহেনার সাথে আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।এক সাথে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা,বিলে গিয়ে শাপলা শালুক তোলা। পুকুরে সাঁতার কাটা আরো কত কি।ভাবনা কাটিয়ে ইমন বলে চাচা আমি চলে যাই।
বিদায় নিয়ে চলে যাবার পরে পুকুর পাড়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।কাছে গিয়ে দেখে সুহেনা।এখনে আবার কোন সময় আগ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসিছ সুহেনা।
তুমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে আবার কোন সময় আসো তার কি কোন ঠিক আছে।
তুমি আমার ছোট বেলার সঙ্গী ছিলে।
তোমার ময়ার ছায়া আজ আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আমার পরাণ আজো উন্মাদ হয়ে আছে, তোমার স্পর্শ কারার জন্য।
যে স্পর্শ করলে শত আঘাতের ক্ষত সরে যায়,তৃষ্ণাত্বে ঢলে থাকা গাছকে পানি দিয়ে সতেজ করা হয়। আমি এমন ব্যাকুল হয়ে আছি।আমার অনুভূতি গুলো আজো মনে হানা দেয় তোমার সাথে থাকতে।
তোমার চেহারা কি কোন কালে দেখতে পাবো।
বলে সুহেনা অজোরে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।
আর বলে এই নাও তোমার জন্য নারিকেলের নাড়ু এনেছি।শহরে যাওয়ার পথে ক্ষুুধা লাগলে খেয়ে নিও।সুহেনার হাত থেকে নাড়ু নিয়ে কোন কাথা না বলে ইমন পথ চলে।আর ভাবতে থাকে। ভাবনা আজ ইমনকে দিশেহারা করতেছে।
ইমনের শহরে গিয়ে পৌঁছায় মনে হলো এ যে এক নতুন দুনিয়া।এর আগে শহরে আসছে কিনা মনে পড়ে না তেমন।
কাজের খুঁজতে থাকার পর দুই তিন দিন পরে হকারের এক কাজ নেয়।
রোজ সকালে অফিস আর বসা-বাড়িতে কাগজ দিয়ে। পরের সময়টা পুরো দিন ঘুরে ঘুরে শহরের এখান থেকে ওখানে যায়।
রাত হলে কোনো বস্তির গলির মুখে আবার কখনো ফুটপাতে ঘুমাই।
আবার নতুন সকালে আবার কাজ শুরু করে, এই ভাবে চলতে থাকে।
মাস খানিক পরে হোটেলে কাজ নেয়।তখন থাকার জায়গাটা নিদিষ্ট হয়।দিন রাত কাজ করে।কোন অবসর নেই।
অবিরাম কাজ করতে থাকে যেন কোন কান্তি তাকে গ্রাস করতে পারে না।
তার স্বপ্ন তার বাবাকে জেল থেকে মুক্তি করবে।সুহেনাকে নিয়ে অনেক কিছু উপহার দিবে।গ্রামে গিয়ে জমি কিনে নতুন বাড়ি করে বসত করবে। সুহেনা কে নিয়ে আরো গাঢ় স্বপ্ন দেখেবে।
হঠাৎ একদিন শরীল অসুস্থ হয়ে যায়,কিন্তু
শরীল থেকে অসুখ সরে না।ইমন তার মাকে অসুস্থ শরীলে ঘুমে স্বপ্ন দেখে তার মা তাকে ঘুমপাড়াচ্ছে।
হঠাৎ সকালে শরীল ভীষণ খারপ হতে থাকে তাকে কেউ ডাক্তারের কাছে নিবে তার মানুষ নেই।হোটের ম্যানেজার তাকে রিক্সায় তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
ইমনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।তার শরীল কিছুটা ভালো হয়। ইমনকে যে সেবা করে সুস্থ করে তুলে সেটা হাসপতালের হামিদ ভাই।
তাকে সবাই লাশকাটা হামিদ বলে ডাকে।
ইমন হোটেলে আর যাবে না বলে স্থির করে। সে হামিদের সাথে থাকে আবার মাঝে মধ্যে মর্গে গিয়ে লাশ কাটার ঘরে হামিদকে সাহায্য করে।অল্প দিনের মধ্যে সে লাশকাটা
সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়।এবং ভালো কিছু টাকা উপার্জন করে।
হামিদ দুই দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাই।
হামিদ ইমনকে বলে যাই যদি কোন লাশ কাটা লাগে সে নিজে নিজে করতে।
পরের দিন সন্ধ্যায় এক লাশ আসে মর্গে ইমন প্রথম কোন লাশ একা কাটবে।তার মনে কিছুটা ভীতি কাজ করছে তবুও তাকে লাশ কাটতে হবে।
ইমন জানলো লাশটা নাকি বহুদূর এক গ্রাম থেকে এসেছে।আবার সেটা মেয়ের লাশ।
সন্ধ্যা থেকে রাত হচ্ছে মাত্র আজ কেন যেন হাসপাতালের পরিবেশটা নীরব।আজ আবার পূর্ণিমার রাত মর্গের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। ইমন সিগেরট টানছে।
লাল চাদর দিয়ে ডাকা লাশটা।
মেয়েটা ফাঁসিতে আত্মহত্যা করছে।
লাশের মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিল,তখন লাশের মুখে চাঁদের আলো পড়ে।
ইমন লাশটিকে চেয়ে দেখে চিৎকার করে উঠে। এটা সুহেনা।
মর্গের বাহিরে ইমন এসে দেখে আতা চাচা বসে আছে।দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরে বলে আতা চাচা সুহেনার এমন অবস্থা কেমন করে হলো।
আতা চাচা বলে,সুহেনা গত সন্ধ্যায় পুকুরে যাই পানি আনতে বেপারীর ছেলে সুহেল তার সাথীরা মিলে তোরা যে বাড়িটা বেপারীর কাছে বিক্রি করছত সেই ঘরে আমার সুহেনাকে ধরে নিয়ে নষ্ট করে দেয়।
আমি বাজার থেকে ফিরে দেখি সুহেনা লজ্জ লুকাতে ঘরে ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলে আছে।
ইমন মর্গে আবার দৌঁড়ে যায়।
সুহেনার লাশটাকে বার বার ছুঁয়ে দেখে।
সুহেনা আর নিজ চোখে দেখতে পাড়ল না আমাকে।
লাশে সুহেনাকে বড় বিদ্রোহী লাগছে।মনে হয় কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গেছে।
ঠোঁট গুলো ছায়ের মতো হয়ে আছে।
সুহেনা আমার দেওয়া উপহার কি মর্গে তোমার লাশ কাটব। আমি ইমন বেঁচে থাকতে কোন কালে পাড়ব না বলে বার বার চিৎকার করে।