ইউনুছ আলী: কবি কালাম আজাদ। দেশবিখ্যাত কবি। মূল নাম মোঃ আবুল কালাম খান। ডাক নাম আজাদ। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৬ আগস্ট সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন আলহাজ্ব হবিবুর রহমান খান এবং মাতা আয়েশা চৌধুরী এশা। মা-বাবার সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। শিক্ষাজীবনের শুরু স্থানীয় ফুলতলি মক্তবে। এরপর তিনি জকিগঞ্জের ইছামতি হাইস্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন। সিলেট এমসি কলেজে কিছুদিন অধ্যয়ন করার পর মৌলভীবাজার কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে ইতিহাস, সমাজ ও মানুষের প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দান করে।
শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়ে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে গেছেন। তিনি ১৯৭৬ সালে ইতিহাস বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে যোগদান করেন। মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৭৮ সালে তিনি ঐ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। একটানা বত্রিশ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০০৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
প্রবাদ আছে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।’ কালাম আজাদ অবসরে গিয়েই কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে নেননি। এই বয়সেও তিনি সিলেটের সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
কবি হিসেবে কালাম আজাদের খ্যাতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে মানুষের অন্তর্নিহিত মানবিক গুণাবলী, ন্যায়বিচার, সমাজের বৈষম্য, প্রান্তিক মানুষের জীবন এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— সম্পাদক সমীপে (১৯৯১), নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা (১৯৯১), শতাব্দীর বৈশাখে আমার বর্ণমালা (১৯৯৪), মৃত্তিকার ছাইভষ্ম (২০১২), বায়বীয় বর্ণমালা, বয়েসি প্রপঞ্চ (২০১৬), শেষের আলোয় সিক্ত শিশির (২০১৮) এবং জীবন ও গল্প (২০১৯)। এছাড়া তাঁর দুটি ছোট কবিতার বই রয়েছে— তুচ্ছ কথার গুচ্ছ (১ ও ২)। তাঁর কাব্যগ্রন্থ নগ্নতার নিজস্ব প্রতিমা সম্পর্কে ড. এম. শমসের আলী মন্তব্য করেছিলেন— “এটি ইংরেজিতে অনূদিত হলে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি আশ্চর্যের কিছু নয়।”
কবি কালাম আজাদের কবিতায় মানবপ্রেম, ন্যায়বোধ ও সহমর্মিতা প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি দুর্বল ও বঞ্চিত মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। যেমন তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে—
“যার সংগীত নেই তার চিৎকার কেড়ে নিওনা সভ্যতা / যার সংগী নেই তার একতারা ভেঙে দিওনা মানুষ / যার ঘর নেই তার পথ ছেড়ে দাও হে ধৃতরাষ্ট্র।”
এই পঙ্ক্তিগুলোতে দেখা যায়, কবি নিঃসঙ্গ মানুষের সামান্য ভরসাও ভেঙে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং গৃহহীনদের জন্য অন্তত পথটুকু ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে কবি কালাম আজাদ একজন মানবিক, সংবেদনশীল ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন।
এছাড়া তাঁর ‘মানুষ কি আর সমান সমান হয়’ শিরোনামের আরেকটি কবিতার দু’টি লাইন এমন,“আমি শুধু আমার মতো / তোমার মতো নয়।” এই অংশে কবি মানুষে মানুষে ভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ স্বতন্ত্র এবং নিজের মতো করেই অনন্য। কেউ কারও সম্পূর্ণ অনুরূপ হতে পারে না। এখানেও কবির অন্তর্দৃষ্টি ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে প্রত্যেক মানুষের স্বকীয়তাকে মূল্যায়নের আহ্বান জানান। এর মধ্য দিয়ে তাঁর কাব্যচেতনায় স্বাধীনতা, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং মানবিক মর্যাদাবোধের প্রতিফলন ঘটে।
সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ডা. এ. রসুল সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫), বাংলাদেশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র সম্মাননা (২০১৬) এবং রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬)। এছাড়া ২০১৯ সালে জালালাবাদ কবি ফোরামের আয়োজনে সিলেট শহীদ সুলেমান হলে দুই দিনব্যাপী “কবি কালাম আজাদ সাহিত্য উৎসব” অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়।
ব্যক্তিজীবনে তিনি স্ত্রী রোকসানা রীনা খান ও তিন সন্তান নিয়ে সুখী পরিবারে বসবাস করছেন। তাঁর বড় মেয়ে আয়েশা আঞ্জুমান আরা খান একজন স্কুল শিক্ষিকা, ছোট মেয়ে নাহিদ ফাতেমা খান কানাডার রক হিল ইউনিভার্সিটিতে ডাইরেক্টর অ্যাডমিশন এবং একমাত্র পুত্র হাবিব মোহাম্মদ মহসিন হাসান খান কানাডা প্রবাসী।
কবি কালাম আজাদ একাধারে একজন শিক্ষক, কবি ও সমাজসচেতন ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠা মানবতা, ন্যায়বোধ, বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি ও সহমর্মিতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর অবদান দীর্ঘদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক:
শিশুসাহিত্যিক ও সম্পাদক, কিশোরতারা