সেই চিঠিটা
রফিকুল নাজিম

বইগুলোকে নতুন বুক সেলফে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে চিঠিটা সুরভীর হাতে পড়ল। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস- কবি। বইয়ের মলাটের রঙ খানিকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেই বইয়ের ভেতরই ছিল একটা চিঠি। এগারো বছর আগের চিঠি। অথচ আজই প্রথম পড়ছে সে। বেশ কয়েকবার চিঠিটা পড়েছে। শাফিনের গোট গোট হাতের লেখা। কী সুন্দর! মুক্তার দানার মত শব্দের পর শব্দ গেঁথে চিঠিটা লিখেছে সে। স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় এই সুন্দর হাতের লেখার জন্যই শাফিন সবার কাছে এক্সট্রা কদর পেতো। শিক্ষকরা খুব আদর করতেন। প্রেমিক বন্ধুদের কাছেও ছিল তার দারুণ জনপ্রিয়তা। বন্ধুদের প্রেমপত্র তাকেই লিখে দিতে হতো। সবই আজ বিস্মৃত স্মৃতি। আবার চিঠিটা পড়ার জন্য সুরভী হাতে নেয়।

সুরভী,
কোনো একদিন জলেশ্বরী নদীর তীরে বিকেলের শেষ গোধূলিকে সাক্ষী রেখে তোর সামনে এসে দাঁড়াবো।মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেইদিন চিৎকার করে বলব- ‘ তোকে খুউব ভালোবাসি, সুরভী।’

একদিন প্রেমিক হয়ে আমি ফিরেই আসবো। অপেক্ষায় থাকিস। থাকবি ত?

ইতি
শাফিন।

বাইরে অঝরে বৃষ্টি পড়ছে। রহমত মাস্টারের টিনের চালে বৃষ্টির টাপুরটুপুর শব্দ গোপন বেদনাবোধ জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সুরভীর মনে। শাফিনটা বরাবরই খুব ভীতু প্রকৃতির ছিল। ভালোবাসি বলার মত দুঃসাহস তার ছিল না। তবে গ্রুপ স্টাডি করার সময় সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আড়চোখে সুরভী দেখতো। সুরভীর চোখে হঠাৎ চোখ পড়লেই সে আলগোছে তার চোখ সরিয়ে নিতো। সুরভীকে অন্য কারো সাথে কথা বলতে দেখলে ভীষণ অভিমান করতো শাফিন। ছেলেমানুষের মত গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো। দুয়েক দিন সুরভীর সাথে কথা বলতো না। আড্ডায় আসতো না। যখন আর পারতো না, তখন সুড়সুড় করে সুরভীর সামনে এসে বসতো। সুরভী শাফিনের এমন ছেলেমানুষি দেখে মনে মনে দারুণ মজা পেত। অথচ শাফিন কখনো সুরভীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতো না। পড়াশোনা কেন্দ্রিক কথাগুলোও সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলতো। শাফিন ঘরোয়া টাইপ ছেলে। কলেজের সময় ছাড়া বাকি সময় সে কোথাও কোনো আড্ডায় বন্ধুদের সাথে শরীক হতো না। বইপোকা বলতে যা বুঝায়- তাই শাফিন। বইয়ের কালো অক্ষরগুলোকে সে যতটা চিনতো ও বুঝতে পারতো, তার একশো ভাগের একভাগও যদি সুরভীর চোখের ভাষা সে বুঝতে পারতো- তাহলে হয়তো আজ সুরভীর জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে সে বাবার বাড়িতে আছে। বাড়ির পাশেই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ায়। আসলেই জীবন বড্ড অদ্ভুত!

কলেজের শেষদিন পর্যন্ত সুরভী শাফিনের জন্য অপেক্ষা করেছে। সে চাচ্ছিল শাফিন তাকে কিছু একটা বলুক। একটু প্রশ্রয়। খানিকটা আশকারা। কিন্তু কিছু না বলেই সেদিন শাফিন চলে গিয়েছিল। চলে যাওয়ার সময় এই বইটা সে সুরভীর হাতে দিয়েছিল। প্রচন্ড রাগে অভিমানে সেই বইটি কখনো পড়েও দেখেনি সে। বসার ঘরের বুকসেলফে বইটি তোলা ছিল। সেইদিন শাফিনের চলে যাওয়ার পর সুরভী অনেক কেঁদেছিল। তার বান্ধবী নাসরিনের গলা জড়িয়ে সেদিন পাগলের মত কেঁদেছিল। আজও যেমন কাঁদছে।

লেখক;
রফিকুল নাজিম
উপজেলা শিক্ষা অফিস
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *