আয়নাটা ভাঙার শব্দ ঠিক যেন রাতের নিস্তব্ধতায় একটা চিৎকার। তীক্ষ্ণ। থেমে যায়নি, এখনো কান জুড়ে বাজে।
তিথি আয়নার টুকরো গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। তার নিজের প্রতিচ্ছবি ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। কেউ যেন অনেকগুলো তিথিকে কেটে কেটে ছড়িয়ে দিয়েছে—কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
সে হাঁটু গেড়ে বসল আয়নার পাশে। একটা ছোট টুকরো হাতে তুলতেই কেটে গেল আঙুল। লাল রক্তটা প্রথমে ছড়িয়ে পড়ল টুকরোটার উপর, তারপর মেঝেতে। কিন্তু ব্যাথা পেল না সে। চোখটা কাঁপলো না। যেন শরীর তার নয়, অথবা এ ব্যাথা বহু দিনের পুরনো, এখন আর কোন প্রভাব ফেলে না।
এই আয়নাটাই ছিল তার একমাত্র সাথী, ছোটবেলা থেকে। মায়ের রেখে যাওয়া। মা বলতো,
“এই আয়নার দিকে তাকালেই তুমি সত্যিকারের তিথিকে দেখতে পারবে। কখনো ভুলে যেও না তুমি কে।”
কিন্তু তিথি ভুলে গিয়েছিল। আয়নাও হয়তো আর সহ্য করতে পারেনি।
কিছুদিন পর…
তিথি তার পুরনো ডায়েরিটা বের করল—নীল মলাট, বাদামি হয়ে আসা পাতাগুলো। পাতায় পাতায় গন্ধ লেগে আছে বৃষ্টির, অপেক্ষার, আর কিছু অস্পষ্ট কান্নার।
একটা পাতায় লেখা—
“আজ আব্বু চলে গেল। চুপচাপ। আম্মু কিছু বলেনি। শুধু একটা থালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বুঝিনি তখন, কিন্তু এখন বুঝি—ওটা ভাতের থালা ছিল না, ওটা ছিল না বলা বিদায়ের প্রতীক।”
আরেকটা পাতায় লেখা—
“আমি ঠিক মানুষ নই। আয়নায় তাকালে আমি নিজেকে ভয় পাই। চোখের নিচে যে ছায়াগুলো দেখা যায়, এগুলো কি? আমি জানিনা। আমি হয়তো নিজেরই ভয়ে আছি।”
এই ডায়েরির পাতাগুলোতে সে যত লিখেছে, তত নিজেকে হারিয়েছে। তার প্রতিটি লেখায় এসে “আমি” বলেছে, কিন্তু তার কথা বলেছি সে জানেনা। আয়নাটা ভাঙ্গার আগ পর্যন্ত তিথি জানতো না, সে একটা দীর্ঘ আত্মভ্রমণে ছিল, নিজের সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার এক অপূর্ণ যাত্রায়।
ডাইরির এক পৃষ্ঠায় খুব ছোট করে লেখা ছিল—
“মা আয়নার সামনে কথা বলতো। যেন কেউ ছিল, আমি ছাড়া।”
তিথি হঠাৎ মনে করতে চেষ্টা করল—শৈশবের সেই সময়, যখন তার মা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। চুল আচঁড়াতে আচঁড়াতে যেন কারো সঙ্গে কথা বলতো। কখনো হাসতো, কখনো একদম চুপ হয়ে যেত। ছোট তিথি ভেবেছিল, হয়তো মা কল্পনায় নাটক করছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা অন্য কিছু।
তিথির মা, নীরা রহমান, ছিলেন গ্রামের এক উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু সমাজের চোখে “অদ্ভুত” নারী। মানুষ বলতো,
“নীরা মাঝে মাঝে আয়নায় কারো নাম নেয়, নাকি নিজের সাথে কথা বলে—কে জানে।”
আর এইসব “অদ্ভুততার” জন্যই তিথির বাবা ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
তিথি আয়নার ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলো সামনে বসিয়ে বলল,
“তুমি কি আমাকে রেখে গিয়েছিলে মা? নাকি আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, আর তুমি খুজঁতে পারো নি?”
হঠাৎ ভেতরে একরকম অস্বস্তি হলো। মনে হলো, আয়নার কাচঁগুলোর ভেতরে কারা যেন তাকিয়ে আছে—অনেক পুরনো চোখ। হয়তো তার মায়ের, হয়তো তার নিজেরই—সে যে ছিল বহু বছর আগে।
অনেক বছর পরে তিথি গেল তাদের পুরনো গ্রামের বাড়িতে। ঘরটা এখন পরিত্যক্ত, দেয়ালে ফাটল, ছাদের একপাশে ধসে পড়েছে। জানালার পাশে পুরোনো সেই কাঠের চৌকি, যেখানে বসে মা আয়নার সামনে বসে কথা বলতো।
ঘরের এক কোণে একটা ছোট লোহার সিন্দুক। খুলতেই দেখা গেল একটা চিঠি—হাতে লেখা, কিছুটা ঝাপসা। চিঠির ওপরে নাম লেখা ছিল—
“প্রিয় আয়নার-মানুষটি,
তুমি যদি সত্যিই আমার মেয়ে হয়ে থাকো, একদিন এই চিঠি পড়বে….”
তিথির হাত কেঁপে উঠলো।
“আয়নাতে মা আমাকে রেখে গিয়েছিল? সেই ‘মানুষটা’ আমি?”
চিঠিটা ছিল অসমাপ্ত। কিন্তু শেষ লাইনে একটা বাক্য ছিল—
“নিজেকে ভেঙে ফেললে, আবার গড়ে নাও। কারণ, একমাত্র ভাঙা আয়নাতেই আসল প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।”
তিথি পুরনো বাড়ির ভেতরের আরেকটি ঘরের দরজা খুলল—একটা ছোট অন্ধকার ঘর, যে ঘরের অস্তিত্বই সে বলে গিয়েছিল। দেয়ালে দেয়ালে আয়না—বড় ছোট, চৌকো, গোল, ছেঁড়া, ধুলোতে ঢেকে থাকা।
এই ঘরটা নীরা বানিয়েছিলেন, লোকেরা বলতো আয়নাঘর। কেউ যেত না। তিথিও কখনো ঢোকেনি।
আজ, অনেক বছর পর সেই ঘরের বাতাসে পচে যাওয়া কাঠের গন্ধ, পুরনো সময়ের ছায়া ভেসে উঠলো। প্রতিটি আয়নাতে শুধু তিথির প্রতিচ্ছবি নয়—তিথির মায়ের ছায়াও ভাসছিল।
হ্যাঁ, এটা কল্পনা—তবুও সত্যি।
একটা আয়নার ফ্রেমে আঙুল বোলাতেই পেছন থেকে একটা খসখসে কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো—
“তুমি ঠিক জায়গায় এসেছো, তিথি। এখন তুমি আমাকে দেখতে পারো।”
তিথি চমকে উঠল। পেছনে কেউ নেই। কিন্তু বুকের ভেতর যেটা বাজছে, সেটা ভয় নয়—একটা স্বস্তি। যেন বহু বছর পর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে।
তিথি খুঁজতে খুঁজতে মায়ের একটি পুরনো নোটবুক খুঁজে পেল। তাতে লেখা ছিল—
“তারা বলে আমি পাগল। আমি শুধু আয়নায় নিজের ছায়া দেখি। আমি ভয় পাই না, কারণ সে আমিই। আমি শুধু ভিন্নভাবে দেখি, যেভাবে ওরা দেখে না।”
এই লেখাগুলো পড়ে তিথি বুঝতে পারল—তার মা পাগল ছিল না, বরং এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি নিজের ভেতরের সত্যিকারের সত্তাকে খুঁজে পেতে গিয়ে সমাজের চোখে অদ্ভুত হয়ে উঠেছিলেন।
তিথির মনে হল—মা আয়নার ভেতর একটা দরজা তৈরি করেছিলেন। একটা সেতু, যেখান দিয়ে সে নিজের বাস্তব সত্তার কাছে যেত।
তিথির মাথার ভেতর প্রশ্ন ঘুরতে থাকলো—
- “আমি কি আমার মায়ের মত হয়ে যাচ্ছি?”
- “নাকি আমি সত্যিই প্রথমবার নিজের কাছে পৌছাতে পারছি?”
সে আয়নার এক টুকরো হাতে তুলে নিল। নিজের চোখের দিকে তাকালো। এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো মুখে।
এই প্রথম তিথি দেখল, আয়নায় শুধু প্রতিচ্ছবি নয়, অতীতও প্রতিফলিত হয় এবং আমরা যখন ভেঙে যাই, তখনই সবচেয়ে সত্যি রূপে নিজেকে দেখি।
আয়না ঘরের পেছনের দেয়ালের একটা খোপে তিথি পায় আর একটা জিনিস—একটা কালচে চামড়ার ডায়েরি। তার ওপরে ছোট করে লেখা:
“ছায়ার ডায়েরি — নীরা রহমান।”
ডাইরির শুরুতে ছিল একগুচ্ছ অদ্ভুত বাক্য, যেন মানসিক ভারসাম্যহীন কারো লেখা। কিন্তু পাতার পর পাতা পড়তে পড়তে তিথির চোখ ফাঁকা হয়ে গেল।
ডায়েরিতে লিখা ছিলো—
“আমার ভেতরে আরোও একজন আমি থাকে। সে চুপ করে সব দেখে। কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার জায়গায় এসে সে দাঁড়িয়ে যাই।”
“তিথির জন্মের দিন আমি কাঁদিনি, কেঁদেছিল আয়না।”
“আমি জানি একদিন আমার মেয়েও আয়নার পথ ধরবে। আমি ভয় পাই। তবুও এ পথ সত্য।”
তিথি ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠা পড়ছিল আর যেন ভেঙে পড়ছিল নিজেই। তার মনে হচ্ছিল—তার মা মানসিক রোগী ছিলেন না, বরং “বিপদজনক সত্যের দর্শক” ছিলেন।
সেই সত্যটা কী?
নিজেকে ভেঙে ফেলে পুনর্গঠনের এক যন্ত্রণা, যেটা সমাজ বোঝে না।
তিথির মনে পড়ে গেল সেই ভয়ঙ্কর রাতটার কথা, যখন সে প্রথমবার আয়নায় নিজের মুখ চিনতে পারেনি। সেটা তার কৈশোরের সময়—পরীক্ষার চাপ, সমাজের মানদন্ড, প্রীতিহীন শৈশবের হাহাকার, আর সর্বোপরি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন।
সেদিন সে আয়নায় তাকিয়ে দেখেছিল—একটা ক্লান্ত, ধূসর মুখ। চোখ জোড়া ফাঁকা, অথচ কাঁদছে।
“তুমি কে?” — প্রশ্ন করেছিল আয়নায় থাকা মানুষটি।
“আমি তিথি”—সে বলেছিল।
“তুমি তো আমার মত দেখতে, কিন্তু তুমিও কি ভেতর থেকে ভাঙা?”
সে রাতেই সে প্রথম নিজের কাধেঁ ভার টের পেয়েছিল—শুধু নিজের না, মায়ের ভেতরকার অপরিণতি আকুতি, অতৃপ্তি, অপরাধবোধ—সব যেন রক্তের ভেতর মিশে গেছে।
তিথি এখন আবার আয়নার সামনে। এবার ভাঙা আয়নার সব টুকরো সে একে একে সাজিয়ে নিচ্ছে—না জোড়া দিতে নয়, বরং প্রতিটি টুকরো মধ্যে নিজের একটা দিক খুঁজে পেতে।
একটাতে কে দেখে ভীতু তিথিকে,
একটাতে প্রশ্ন করা তিথি,
আরেকটাতে মায়ের ছায়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা তিথি।
সে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আয়নার পাশে বসে। এবার আয়নায় আর ছায়া নেই, আছে আলোয় ঝলমল করা একটি মুখ—নিজের শান্ত, কাঁদা মুখ, কিন্তু সত্যিকারের।
এই প্রথমবার সে নিজেকে স্পর্শ করতে পারল—চোখ দিয়ে নয়, হৃদয়ের ভেতর দিয়ে।
অনেকদিন পর,
এক সন্ধ্যায় তিথির হাতে এক অদ্ভুত চিঠি এসে পৌঁছায়—কোন প্রেরকের নাম নেই, শুধু খামে ছোট করে লেখা:
“ভাঙ্গা আয়নার ভেতর কেউ তোমার অপেক্ষায় আছে।”
চিঠির ভেতরে এক পরিচিত হাতের লেখা:
“আমি তোমার মায়ের চিকিৎসক ছিলাম। নীরা রহমান নিজেকে পাগল বলেনি কখনো। সে শুধু এক বিশেষ সত্যকে বুঝতে পেরেছিল, যেটা আমরা কেউ সাহস করে দেখি না—নিজের মুখ। নিজের ছায়া। তুমি তার উত্তরসূরী। তুমি এখন ঠিক সেই ধাপে দাঁড়িয়ে আছো, যেখানে সে একদিন থেমে গিয়েছিল। তুমি কি সামনে এগিয়ে যাবে?”
চিঠিটা ছিল এক প্রস্তাব। চিকিৎসক না, একজন বন্ধু। একজন ভিন্ন রকম মানুষ—নাম রাশেদ আহমেদ। মনস্তত্ত্ববিদ, যিনি নীরার জীবনের একমাত্র শ্রোতা ছিলেন।
তিথি তাকে খুঁজে বের করে। বহুদিন পর সে কারো সাথে কথা বলে, কান্না করে, হাসে।
রাশেদ তাকে বোঝান—নিজের ভেতর যা আছে, তা নিয়ে লড়াই নয়, গ্রহণ করাই মুক্তি।
রাশেদের কাছ থেকে তিথি জানতে পারে মায়ের একটা রেকর্ড রাখা ছিল—সে সময়কার শেষ অডিও নোট।
পুরনো ক্যাসেটের ফিতের ভেতর থেকে শোনা যায় নীরার কন্ঠ:
“আমার মেয়েটা যদি একদিন এই কণ্ঠ শুনে, তবে জেনে রেখো, আমি কখনো চাইনি তুমি আমার মত হও, আমি শুধু চেয়েছি তুমি সাহস পাও—নিজেকে ভালোবাসার, নিজের ভয়কে ছুঁয়ে ফেলার। মানুষ আয়নায় নিজেকে যেমন দেখে, বাস্তবেও তেমনটা নয়। তুমি বাস্তব হও। কারণ তুমি জীবিত। তুমি আমার গল্প নয়, নিজের গল্প লিখো।”
চিঠিটা পড়ে তিথির চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে কষ্ট নয়—ক্ষুধা।
একটা নতুন জীবনের জন্য, যেখানে ভয় থাকবে, ছায়া থাকবে, কিন্তু পালানোর দরকার হবে না।
কিছুদিন পর…
তিথি আজ আয়নাঘরে আবার বসেছে। কিন্তু এইবার সে আয়নাগুলো না ভাঙ্গে, না ঘৃণা করে।
সে শুধু একটার দিকে তাকিয়ে বলে—
“আমি তিথি। আমি ভেঙে গিয়েছিলাম, আমি আবার গড়েছি নিজেকে। আমি মায়ের গল্পের চরিত্র না, আমি আমার গল্পের লেখক।”
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে একটা পুরনো কাগজ খোলে। ডায়েরির খসড়া। শিরোনাম দেয়—
ভাঙা আয়নার ভেতর আমি — একজন মানুষের নিজে কিছুয়ে ফেলার গল্প