অব্যক্ত ভালোবাসা

গোলাপ মাহমুদ সৌরভ

সাগর ধারী গ্রাম হাসি ও মাহিনের। এ গ্রামের আলো বাতাস গায়ে মেখে তাদের বড়ো হয়ে ওঠা। কৈশোর জীবন থেকেই তাদের মাঝে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাসি ও মাহিন একসাথে পড়াশোনা করে এসেছে। হাসি ও মাহিন দুজনেই অত্যন্ত গরীব ঘরের সন্তান। কষ্ট কাকে বলে তারা হারে হারে বুঝে তাছাড়া কষ্টের সাথে সংগ্রাম করেই তাদের জীবন চলে। মাহিনের বাবা সাগরে নৌকা ভাসিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন আর হাসির বাবা অনন্যের জমিতে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারপরও তাদের সংসারে যেন সুখের কমতি নেই, হাসি আনন্দে কেটে যায় প্রতিটি দিন। ক্লান্ত দুপুরে সাগরে গা ভিজিয়ে ডুবে গোসল করার আনন্দই অন্যরকম। স্কুল ছুটি হলেই পাড়ার ছেলে-মেয়ে ছুটে যায় সাগরের কিনারে হাত-পা নেড়ে সাঁতার কেটে গোসল করতে। একজন আরেকজনকে পানি ছিটাছিটি খেলা হৈ-হুল্লোড় আর কোলাহলে কেটে যেতো সময়। এভাবেই হাসি ও মাহিনের বড়ো হয়ে ওঠা। এভাবেই দুজন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখে হাসি ও মাহিন। মাহিন মাঝে মাঝে বাবার সাথে নৌকা চড়ে মাছ ধরতে যায়। এমনকি হাটেও যায় মাছ বিক্রি করার জন্য। হাসি মাঝে মাঝে মাহিন কে দুষ্টুমি করে কবুত বলে ডাকে। মাহিনও হাসি কে কবুতনি বলে ডাকে। হাসি ও মাহিন কারো ডাকে কেউ কখনো অভিমান কিংবা রাগ করে না বরং আনন্দের সহিত হাসিতে শরিক হয়। একদিন মাহিন তার বন্ধুর কাছ থেকে শুনতে পায় হাসি কোন এক ছেলের সাথে কথা বলে তখনই মাহিন মন খারাপ করে চুপ করে থাকে কিছু না বলে স্থান ত্যাগ করে বাড়িতে চলে যায়। সাগরের কিনারে বসে চুপচাপ সাগরের জলে ভেসে আসা ঢেউ গুলো দেখছে আর মনের ভিতরের ঢেউ গুলো কান্না হয়ে চোখে বৃষ্টি ঝরছে। মাহিন সাগরের ঢেউ কে প্রশ্ন করে বলে আচ্ছা সাগর তোর কী কোন দুঃখ আছে যার কারণে তোর বুকে এতো ঢেউ? তোর দুঃখের সাথে আমার দুঃখের একটু ভিন্নতা আছে কারণ তোর দুঃখ দেখে সবাই বলে ঢেউ আর আমার দুঃখ গুলো আমি ছাড়া বুঝে-না কেউ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে কিন্তু মাহিন সাগরের পাড়েই বসে আছে। হাসি আবার সন্ধ্যা হলেই সাগর থেকে জল আনতে কলসি নিয়ে যায়। হটাৎ হাসি দেখতে পেলো মাহিন মন খারাপ করে চুপ বসে আছে। হাসি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল মাহিন সন্ধ্যা হয়ে গেলো বাড়ি যাবে না, তোমার কী মন খারাপ? মাহিন কিছু না বলে ওঠে বাড়িতে চলে গেলো। হাসি বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে। হাসি মাহিনের পিছু পিছু বাড়িতে চলে গেলো। হাসি মনে মনে ভাবছে কাল কলেজে গিয়ে জানার চেষ্টা করবো কী হয়েছে। পরের দিন হাসি কলেজে গেলো, কলেজের মাঠে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো এখনই মাহিন আসবে। কলেজে ক্লাসের সময় পার হয়ে গেলো কিন্তু মাহিন আসছে না। হাসি ক্লাসে চলে গেলো। মাহিন ছাড়া হাসির ক্লাস টা শূন্য মনে হয়। একদিন, দুদিন, এভাবে তিনদিন ক্লাসে যায় না মাহিন। এদিকে মাহিন দুঃখ ভুলার জন্য বাবার সাথে সাগরে মাছ ধরার জন্য ব্যস্ত পড়াশোনা যেন হাসি ছাড়া অর্থহীন। দুজন দুজনকে ভালো বন্ধু বলেই জানে কিন্তু তারা একজন আরেকজনকে ভালবাসে কেউ কোনদিন প্রকাশ করেনি। একদিন হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে মাহিনের বাড়িতে আসে হাসি এসে দেখে মাহিন ঘরে নেই। মাহিনের মাকে বললো আচ্ছা চাঁচি মাহিন কোথায়? মাহিন তো তার বাবার সাথে সাগরে মাছ ধরতে গেছে, তুমি বসো একটু পরেই আসবে। হাসি ঘরে গিয়ে মাহিনের টেবিলে কাছে বসলো আর দেখতে পেলো বই গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। হাসি জিজ্ঞেস করল আচ্ছা চাঁচি মাহিন আজ ক’দিন যাবত ক্লাসে যাচ্ছে না বই গুলো অবহেলা অযত্নে পড়ে আছে তার কারণ বুঝতে পারছি না তাছাড়া আগেতো এমন কখনো দেখিনি মাহিন এমন ছিলোনা। বই গুলো গুছাইতে গিয়ে একটা লেখা চোখে পরলো যা খাতার শেষ পিষ্টা মাহিন লিখেছে আজ বুঝি তোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে প্রথম পিষ্টা থেকে সামনে সাদা পিষ্টা গুলো না বলা কথা অব্যক্ত রেখে শেষ করে দিলাম কারণ এতোটা দিন তুই আমার পাশে থেকেও আমাকে বুঝতে পারিসনি আমিও তোকে কিছু বলার সাহস করিনি তাই না বলা কথা গুলো অব্যক্ত রয়ে যাক শূন্য খাতায়। কিছুক্ষণ আগে মাহিন এলো মুখভর্তি দাড়ি মলিন চেহেরা নিয়ে। মাহিন উঠোনে দাঁড়াতেই হাসি ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। আরে কবুত কেমন আছো? ভালো আছি মাহিন বললো। মাহিন জানিস হাসি অনেকক্ষণ হলো এসেছে তোর সাথে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করছে। কেন এসেছো বলো? মাহিন তুমি আজ তিনদিন হলো কলেজে যাওনা তাই খবর নিতে এলাম কাল কলেজে যাবে? কলেজে গিয়ে কী হবে যেখানে জীবনের সবচেয়ে বড়ো অপ্রাপ্তি অব্যক্ত রয়ে যায়। যা মূল্যহীন ভাবনার কাছে অতীত হারিয়ে যায়। কাল কলেজে আসো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে যা সামনে কাজে আসবে। ঠিক আছে তুমি যাও সন্ধ্যা হয়ে গেলো। পরের দিন মাহিন কলেজে গেলো এবং হাসি কে এরিয়ে চলে মাহিন। কলেজ ছুটির পর হাসি মাহিন কে রাস্তা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল তুমি এমন করছো কেনো কী হয়েছে বলবে তো? আমার কী হয়েছে সেটা তোমার জানা দরকার নেই বরং যাকে পছন্দ করো তাঁকে নিয়ে ভালো থেকো। হাসি মুচকি হেসে বললো মানে, কী বলতে চাও তুমি? শৈশব কৈশোর তোমার আমার একসাথে কেটেছে যদি কোনদিন কোন কথায় কষ্ট পাও ক্ষমা করে দিও। তুমি এতোদিনে এই আমাকে চিনেছো,তাছাড়া তুমি কোনদিন দেখেছো আমি কারো সাথে কথা বলতে হাসি বললো?দেখিনি তবে শুনেছি। তাহলে এটাই তোমার মন খারাপের কারণ! হাসি বললো কারো সাথে যদি আমি কথা বলি তোমার তো কোন সমস্যা নেই তুমি আমি তো বেশ বন্ধু। হাসি বললো শুনো মাহিন ভালোবাসা বুকের ভিতর আটকে রেখে কোনকিছু জয় করা যায় না,বরং প্রকাশ করে নিজের অধিকার টুকু খুঁজে নিতে হয়। তোমার অব্যক্ত ভালোবাসা হতে পারে অযুক্তিক অভিমানের নিঃসঙ্গতার কারণ। সুতরাং ভালোবাসা হোক দুটি মনের প্রাণের স্পন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *